৩০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ১৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ || ২০শে শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

জনশূন্য দ্বীপে শুভ্রতার সৌন্দর্যে পাখির সঙ্গে

নিজস্ব সংবাদদাতা , প্রকাশিত হয়েছে-

 

দেশের একমাত্র পাহাড়ি দ্বীপ, মহেশখালী উপজেলা। সাগরের স্নিগ্ধ নীল জলরাশি, উপকূলীয় বেলাভূমি, বালিয়াড়ির সৌন্দর্য, লোনাপানির বন-পাহাড়ের মায়া কিংবা ছোট ছোট দ্বীপ। কী নেই এখানে! প্রকৃতি এখানে আপন মনে সৌন্দর্যের রঙবাহারি পসরা সাজিয়ে বসে আছে। আর এই দ্বীপ জীববৈচিত্র্য, বিশেষ করে পাখির জন্য বলতে গেলে ভূস্বর্গ। বিশেষ করে শীতকালে এখানে আসে জলচর পরিযায়ী পাখির একটি বড় অংশ। আর এই দ্বীপের আশপাশে ছড়িয়ে আছে বেশকিছু জনশূন্য দ্বীপ বা সংযুক্ত স্থলভাগ, যেখানে মানুষের চলাচল বা উপস্থিতি কোনোটিই নেই। লালদিয়া, কালাদিয়া, সোনাদিয়া ও সংলগ্ন কিছু চর।

শীতের সকাল, ভোর ৬টা। চকরিয়া থেকে কনকনে হিমেল হাওয়াকে উপেক্ষা করে মোটরবাইকে চড়ে এগিয়ে যাচ্ছি ধলঘাট ইউনিয়নের দিকে। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও গ্রামপুলিশের সহযোগিতায় ভাড়া করা হলো একটি নৌকা। নৌকায় করে এগোচ্ছি লালদিয়া দ্বীপের দিকে। এদিকে সূর্য তার মিষ্টি সোনারোদের কিরণে আর হাসিতে প্রকৃতিকে আলোকিত করছে। সামনে দিয়ে কালোমাথা কাস্তেচরা, গুলিন্দা, বাটান বকের ঝাঁক। মাথার ওপর দিয়ে হঠাৎই উড়ে গেল পাতি চখাচখির বড় এক ঝাঁক। দূরে তাকিয়ে দেখি প্রায় ২শর মতো এই প্রজাতির পাখির মেলা। সাথে ছিল খয়রা চখাচখি, পেরিহাঁস, লালসিরসহ দেশি বুনো ও পরিযায়ী হাঁস। প্যারাবনের পাশে ভাটার সময় কাঁদামাটি থেকে খাবার সংগ্রহ করছে কাস্তেচরা, গুলিন্দা, বগা আর বগলারা। এদিকে ঝাঁক বেঁধে উড়ছে বাটান, জিরিয়া। এরপর বঙ্গোপসাগরের নীল জলরাশি, যা মিশেছে নীলদিগন্তে।

নৌকা থামে লালদিয়ার তীরে। শুকনো গাছের গুঁড়ির ওপর বসে আছে কালোটুপি মাছরাঙা, যা আমাদের দেশের একমাত্র শীতকালীন পরিযায়ী মাছরাঙা। মাঝিকে নৌকায় রেখে নামলাম বেলাভূমিতে। পাশে প্যারাবন, জিরিয়া বাটানরা আপন মনে খেয়ে যাচ্ছে বেলাভূমিতে। লালনুড়ি বাটানও আছে। আকাশে উড়ছে মাছমুরাল। সামনে নীল সমুদ্র। হঠাৎ একটা স্যান্ডার্লিং নামক সৈকতপাখি এসে সামনে বসল। অদ্ভুত শুভ্রতার সৌন্দর্যে ঘেরা এই পাখি। খেয়ে যাচ্ছে আপন মনে। হঠাৎ দূরে চোখ আটকালো লাল কাঁকড়ার সমাহারে। দল বেঁধে পায়চারি করছে আর খাবার খাচ্ছে তারা। বেলাভূমির ওপর এ এক অপরূপ সৌন্দর্যের সমাহার! লালদিয়ার একপ্রান্ত থেকে হেঁটে হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছি অন্যপ্রান্তে। বেলাভূমি, সমুদ্র, নীল আকাশ আর প্যারাবন। সুনসান নীরবতার সঙ্গে প্রকৃতির সুরের মূর্ছনায়।

এবার আবারও নৌকায় চড়ে হাঁসের চরের দিকে। মহেশখালীর মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হলেও এটি নৌকা দিয়ে সহজে যাতায়াত করা যায়। পরিযায়ী বুনোহাঁসের উপস্থিতির জন্যই এর নাম হাঁসের চর। ভাটার কারণে পানি তখন নেমে গেছে অনেকটা। কাদার মধ্যে খাবার খাচ্ছিল ধূপনি বক, বগা-বগলারা, লালপা, কাস্তেচরা, গুলিন্দা, বাটান, খন্জনেরা। শঙ্খচিল তার সোনালি ডানা মেলে উড়ছে আকাশে। পাখির পাশাপাশি এখানে আরও রয়েছে সামুদ্রিক কচ্ছপের প্রজননস্থল। জোয়ার বাড়ছে, আর সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমের দিগন্তরেখায়। সাঁঝবাতির লাল আভায়, অস্তাচলের মায়ায় দ্বীপের প্রকৃতি। এদিকে দিনশেষে পাখিরা ফিরছে তার চেনা নীড়ে।

পরের দিন ভোরে আবার যাত্রা শুরু ঘটিভাঙা ঘটে- উদ্দেশ্য কালাদিয়া আর সোনাদিয়া। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ভাটার কারণে ওইদিন ফিরে আসতে হয়। পরের দিন আবার খুব ভোরে বের হই। লক্ষ্য সকাল ৭টার আগে ঘাটে পৌঁছানো। নৌকায় করে ছুটে চললাম কালাদিয়ার দিকে। দুপাশে প্যারাবন। এর মধ্যে মাছরাঙা, পানকৌড়ি, বগা-বগলা, গুলিন্দা বাটান। প্যারাবন পেরিয়ে নৌকা সাগরে দিকে। হঠাৎ দূর থেকে দেখা যাচ্ছে সাদা বকের সারি, মাঝে কিছু কাস্তেচরারও দল। ক্যামেরা লেন্স জুম করে আরও দেখলাম আশপাশে রয়েছে গুলিন্দা, জৌরালী, বাটান, জিরিয়া, নট, ধূসর বকের ঝাঁক। এরা সংখ্যায়ও অনেক। আস্তে আস্তে পাখিকে বিরক্ত না করে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। প্রয়োজনীয় ছবি তুললাম। এত বড় বড় সৈকতপাখির ঝাঁক দেখে মনের মধ্যে এক অদ্ভুত প্রশান্তি আর কৌতূহল কাজ করল! কারা রয়েছে এই পাখির ঝাঁকে? চামুচঠুটি বাটানই-বা কি আছে এই ঝাঁকে! একে একে সবার ছবি তুললাম, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত চামুচঠোটা বাটানের দেখা পেলাম না।

দ্বীপের বেলাভূমিতে ছড়িয়ে আছে হাজারো ঝিনুক, শামুকের খোলস, জীবিত স্টারফিশ, হর্সসো ক্রাব, লাল কাঁকড়াসহ বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণী। সবকিছু মিলে নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক পরিবেশ। পুরো বেলাভূমির একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে হাঁটতে হাঁটতে গেলাম। কাদামাটির মধ্যে সৈকতপাখির খাবার সংগ্রহের কৌশল দেখতে পাওয়া। আসলেই অন্য রকম এক অভিজ্ঞতা!

এবারের উদ্দেশ্য সোনাদিয়া, যা পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। পাশাপাশি সামুদ্রিক কচ্ছপের প্রজননক্ষেত্র। এ ছাড়া পৃথিবীব্যাপী মহাবিপন্ন সৈকতপাখি চামুচঠুটি-বাটানসহ বিভিন্ন বিপন্ন জলচর সৈকতপাখির আবাসস্থল। শীতকালীন পরিযায়ী পাখির একটি বড় অংশের আগমনও ঘটে এই স্থানে। এ ছাড়া, ইরাবতী ডলফিন আর বোতল নোজড ডলফিন, হাম্পড ব্যাক ডলফিনের আনাগোনা এই দ্বীপকে ঘিরেই।

ভাটার কারণে ছোট ছোট চরে ঝাঁক বেঁধে বিশ্রাম নিচ্ছিল গাংচিলের দল, আর পানচিলেরা ব্যস্ত ছিল মাছ ধরে খাওয়ার কাজে। এ ছাড়া লালনুড়ি বাটান, নট, জৌরালি বিশ্রাম নিচ্ছিল আপন মনে। বেলাভূমিতে নামতেই চোখে পড়ল শত শত সৈকতপাখির ঝাঁক। যত ভাটায় পানি নামছে, এরা আপন মনে খাবার খুঁজে খাচ্ছে। বাটান, জিরিয়া, লাল পা, সবুজ পা, স্টিন্ট, স্যান্ডার্লিং, ডানলিনসহ বিভিন্ন সৈকতপাখি আছে এই ঝাঁকে। সমস্ত বেলাভূমিতে ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন প্রজাতির শামুক আর ঝিনুক। কিন্তু অনেক আশা নিয়েও চামুচঠোটা বাটানের দেখা পেলাম না। এরপর ফেরার পালা। আবারও সেই প্যারাবন, প্যারাবনের পাখির ঝাঁক। ঘটিভাঙা ঘাট।

আমাদের উপকূল যে জীববৈচিত্র্য, বিশেষ করে পাখির দ্বারা কতটা সমৃদ্ধÑ মহেশখালী দ্বীপের এসব পাখির অবস্থা দেখলেই তা বোঝা যায়। আসাবে গবেষণায় সমুদ্রতীরবর্তী এলাকাগুলো গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। দ্বীপ এবং উপকূলীয় এলাকার জীববৈচিত্র্য রক্ষা বর্তমান সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। ক্রমবর্ধমান মানব জনসংখ্যা বৃদ্ধি, আবাসস্থল ধ্বংস, দূষণ, শিকার, নগরায়ণসহ বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকিতে রয়েছে আমাদের এই দ্বীপ অঞ্চলের বন্যপ্রাণী। তাদের সংরক্ষণে প্রয়োজন জরুরিভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ।

পৃথিবীজুড়ে জীববৈচিত্র্য গবেষণায় এবং সংরক্ষণে বর্তমানে উপকূলীয় জীববৈচিত্র্যকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ এখানে রয়েছে পৃথিবীজুড়ে সংকটাপন্ন বন্যপ্রাণী, বিশেষ করে পাখির বিশাল এক সম্ভার। আর বাংলাদেশের উপকূলে প্রতিবছর আগমন ঘটে হাজারো পাখপাখালির, যারা বাংলাদেশের পরিবেশ ও প্রতিবেশে গুরুত্বপূর্ণ এক ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।

তবে বর্তমানে উপকূলীয় অঞ্চলের পাখি মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে হুমকির মুখে। তার মধ্যে অন্যতম আবাসস্থল ধ্বংস ও আবাসস্থলের গুণগত মান নষ্ট হওয়া। এ ছাড়া, পর্যটনের ফলে সৃষ্ট সমস্যা বর্তমানে প্রকট আকার ধারণ করেছে। এর ফলে ক্রমাগতই হুমকির মুখে পড়ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও পাখিরা।

সোনাদিয়ার পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। এ ছাড়া পৃথিবীব্যাপী জীববৈচিত্র্যের গুরুত্বপূর্ণ এক স্থান হিসেবেও চিহ্নিত। কিন্তু এই সোনাদিয়ার আশপাশের চরগুলো, যেমনÑ হাঁসের চর, লালদিয়া, কালাদিয়াও গুরুত্বপূর্ণ। এই চরগুলোর সঠিক ব্যবস্থাপনা বর্তমানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। সঠিক ব্যবস্থাপনা ছাড়া অচিরেই আমরা হারিয়ে ফেলব অপূর্ব এই দ্বীপগুলোর প্রাকৃতিক নৈসর্গিক সৌন্দর্য আর এই দ্বীপের পাখিদের।