আজ ভয়াল ২৯ এপ্রিল স্বজনহারাদের আঁতকে ওঠার দিন


এবি নাছিম প্রকাশের সময় : এপ্রিল ২৯, ২০২৪, ৮:২৭ পূর্বাহ্ণ / Print This Post Print This Post
আজ ভয়াল ২৯ এপ্রিল স্বজনহারাদের আঁতকে ওঠার দিন

আজ ভয়াল ২৯ এপ্রিল স্বজনহারাদের আঁতকে ওঠার দিন। এখনও স্বজনরা ডুকরে ডুকরে কাঁদে প্রিয়জনের স্মরণে। গণহারে কবর হয়েছিল, লাখে লাখে মরেছে মানুষ। মানুষের লাশ আর লাশ ভেসে এসেছে সেদিন।

১৯৯১ সালের এদিনে দিনগত মধ্যরাতে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনাসহ দেশের উপকূলীয় এলাকার ওপর দিয়ে ১২ থেকে ২০ ফুট উচ্চতায় জ্বলোচ্ছাসে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘হারিকেন’। লাশের পরে লাশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল চারদিকে। নদী-নালা, ডোবায়, খাল-বিল, সমুদ্রে ভেসেছিল মানুষের লাশ আর লাশ। গরু, মহিষ, ভেড়ার মরদেহের স্তুপ যেন ভয়াল এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য।

বিস্তীর্ণ অঞ্চল ধ্বংস্তূপে পরিণত হয়েছিল। দেশের মানুষ বাকরুদ্ধ হয়ে সেদিন প্রত্যক্ষ করেছিল প্রকৃতির করুণ এই আঘাতের নিদারুণ দৃশ্য। প্রাকৃতিক দুর্যোগের এতবড় অভিজ্ঞতার মুখোমুখী এদেশের মানুষ এর আগে আর কখনো সম্মুখীন হয়নি।

পরদিন বিশ্ববাসী অবাক হয়ে গিয়েছিল সেই ধ্বংসলীলা দেখে। নির্বাক হয়ে তাকিয়ে ছিল জাতি। স্বজনহারানোর অস্থিরতায় বোবা কান্নায় ডুকরে ডুকরে কেঁদেছিল সমগ্র দেশ।

বাংলাদেশে আঘাত হানা ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে নিহতের সংখ্যা বিচারে পৃথিবীর ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে অন্যতম। ঘূর্ণিঝড় এবং তার প্রভাবে সৃষ্ট ২০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে আনুমানিক ১ লক্ষ ৩৮ হাজার মানুষ নিহত এবং প্রায় এক কোটি মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছিল। তবে বেসরকারি হিসাবে এর সংখ্যা আরও বেশি। মারা যায় ২০ লাখ গবাদিপশু। ক্ষতি হয়েছিল ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি সম্পদ।

ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা ক্ষয়ক্ষতির কারণ সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয়েছিল আগে থেকেই। বিভিন্ন গণমাধ্যমে সতর্কবার্তা প্রচার হয়েছিল। সেসময় অনেকেই ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা বুঝতে পারে নি বলে সাইক্লোন সেন্টারে যায় নি। বার বার মাইকিং করা সত্ত্বেও বাড়ি ঘর ছেড়ে যেতে চায় নি’। এটাও ঠিক যে তখন সাইক্লোন সেন্টারও যথেষ্ট ছিল না। যাবেই বা কোথায়? পরিবারে বৃদ্ধ মা-বাবাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। শেষ সময়ে অনেকে ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়ে যাবার সময় বৃদ্ধ মা-বাবাকে নারিকেল গাছের সাথে বেঁধে গেছেন। বাতাসের তীব্র গতিতে গাছের সাথে দুলতে দুলতে কেউ কেউ বেঁচেও গিয়েছিলেন, আবার ভেসেও গেছেন এমন দুঃখের কথাও আমরা শুনেছি মহেশখালী কুতুবদিয়া,চকরিয়া উপজেলার বদরখালির মানুষের কাছে।

কক্সবাজারের বাসিন্দা সামিউল আলম বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের পরে তখন আমরা যা দেখেছি পুরো উপকূল মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল। এলাকায় ফিরে গিয়ে দেখি তখন এক কবরে একাধিক নারী পুরুষ শিশুকে কাফন ছাড়া দাফন করা হচ্ছে। হাটে ঘাটে নালা নর্দমা পুকুরে লাশের সারি। ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাসের আগে নারীরা বলেছিলেন আমরা গরু-ছাগল হাঁস-মুরগি রেখে যাই কেমন করে? এটা নিয়ে অনেকে হেসেছিলেন, কিন্তু ওদের কথায় এটা পরিষ্কার ছিল যে পরিবার বলতে ওদের কাছে শুধু মানুষ নয়, ঘরের পশুপাখিও তাদের পরিবারের অংশ। তাদের ফেলে যাবেন এমন স্বার্থপর তারা নন। সাইক্লোন শেল্টারগুলোতে গবাদিপশু রাখার ব্যবস্থা তখন ছিল না, এখনও নেই। শুধু মানুষ বাঁচানোর চেষ্টা। আবার এই মানুষ যখন অন্য প্রাণীর জন্যে আকুল হয় তখন তাদের সচেতনতার অভাবের কথা বলা হয়।

উপকূলবাসী আজও ভুলতে পারেনি সেই রাতের দুঃসহ স্মৃতি। প্রলয়ঙ্করী এই ধ্বংসযজ্ঞের ৩৩ বছর পার হতে চলেছে। এখনও স্বজনহারাদের আর্তনাদ থামেনি। গৃহহারা অনেক মানুষ এখনও মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিতে পারেনি।

১৯৯১ সালের ওই দিনে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটে কক্সবাজারের মহেশখালীর ধলঘাটা ইউনিয়নে। এখানে এমন কোনো বাড়ি বা ঘর নেই যে বাড়ি থেকে ৫-৬ জন লোক মারা যায়নি। তাই ২৯ এপ্রিল আসলে এখনও প্রতিটি বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে যায়।

কুতুবদিয়া দ্বীপের বাসিন্দা আলম মিয়া ওই রাতের স্মৃতি উল্লেখ করে বলেন, সে ভয়াল রাতের কথা মনে পড়লে চোখে পানি চলে আসে। সেই রাতের কথা কোনোভাবেই ভুলে যাওয়ার নয়। সেই উপকূল এখনো অরক্ষিত।

প্রতিবছর দিনটি উপলক্ষে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে স্থানীয় প্রশাসন, বিভিন্ন সামাজিক -সাংস্কৃতিক সংগঠন দিনব্যাপী নানা অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকেন। স্বজনহারা মানুষগুলোর ঘরে ঘরে দোয়া ও মোনাজাত হয়।


আর্কাইভ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০