ফাটল চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে , অসন্তোষ তদন্ত কমিটির


বার্তা বিভাগ প্রকাশের সময় : জুলাই ৪, ২০২৪, ১১:০৪ অপরাহ্ণ / Print This Post Print This Post
ফাটল চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে , অসন্তোষ তদন্ত কমিটির

 

চট্টগ্রামে এম এ মহিউদ্দিন চৌধুরী এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের লালখান বাজার অংশে অন্তত চারটি পিলারে ফাটল দেখতে পাওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছে তদন্ত কমিটি। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির গঠিত উপকমিটি বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) দুপুরে এক্সপ্রেসওয়ে পরিদর্শন করেন।

লালখান বাজার অংশে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের চারটি পিলারে ফাটল দেখা দেওয়ার বিষয়ে উপকমিটির আহ্বায়ক ও চট্টগ্রাম-১১ আসনের সংসদ সদস্য এম এ লতিফ বলেন, লালখান বাজার অংশের পিলারে আমরা কিছু ফাটল দেখেছি। ছবি তুলে নিয়েছি। আমরা বিশেষজ্ঞ নই। বিশেষজ্ঞদের সাথে এ নিয়ে আলোচনা করব।

এম এ লতিফ বলেন, আমরা পতেঙ্গা অংশ থেকে বিভিন্ন পয়েন্টে দেখেছি। এক্সপ্রেসওয়ের উপরে দু‘পাশের সীমানা দেয়ালে যে ক্লাম লাগানো হয়েছে—সেগুলো মানসম্মত নয়। ফিনিশিংয়ে কিছু সমস্যা আছে। দুয়েক জায়গায় রডও বেরিয়ে আছে। এসব অসঙ্গতি প্রকল্প পরিচালক ও কনসালটেন্টকে দেখিয়েছি।

নির্মাণের সময় কোনো ত্রুটির কারণে ফাটল হয়েছে। এটি নির্মাণাধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের জন্য ঝুঁকি তৈরি করবে কিনা, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে হবে। এজন্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি উচ্চতর কমিটি গঠন করা দরকার। তারপর জানা যাবে ফাটলের গভীরতা কতটুকু এবং কীভাবে এটি মেরামত করা যাবে।

অধ্যাপক ড. জিএম সাদিকুল ইসলাম, অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ, চুয়েট পুরকৌশল বিভাগের তিনি বলেন, পরিদর্শন কাজে কমিটির সবাই উপস্থিত ছিলেন। প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনের পাশাপাশি প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে সভা করা হবে। এছাড়া চট্টগ্রামে নিজেদের মধ্যেও বৈঠক করবে কমিটি। নির্মাণ কাজে কোথাও কোন অনিয়ম হয়েছে কি না তা সব দেখে প্রতিবেদন দেব।

তিনি বলেন, এটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া চার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। এতে কোনো অনিয়ম সহ্য করা হবে না। অনিয়ম হলে জেল জরিমানাসহ সব শাস্তি হবে, সরকার কাউকে ছাড় দেবে না। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন বগুড়া-৫ আসনের সংসদ সদস্য মো. মজিবুর রহমান মনজু এবং সংরক্ষিত আসনের সদস্য পারভীন জামান।

কমিটির তথ্যমতে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা হয়েছে। অভিযোগ তদন্ত এবং নির্মাণকাজের গুণগত মান যাচাইয়ে গত ১০ জুন উপকমিটি গঠন করে দেয় সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। উপকমিটির আহ্বায়ক চট্টগ্রাম-১১ আসনের সংসদ সদস্য এম এ লতিফ।

এদিকে ফাটলের বিষয়ে জানতে চাইলে পরিদর্শক দলের সাথে থাকা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) প্রকল্প পরিচালক মাহফুজুর রহমান বলেন, পিলারের এগুলো ফাটল নয়, এয়ার ক্র্যাক। নির্মাণের সময় কংক্রিটের আধিক্যসহ নানা কারণে নির্মাণাধীন অবকাঠামোতে এ রকম ফাটল হয়ে থাকে। এটা গভীর কোনো ফাটল বা বড় কোনো কিছু নয়। এই ফাটলে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সক্ষমতায় কোনো প্রভাব ফেলবে না। তারপরও এখানে গাড়ি তুলে যাচাই করা হয়েছে, কোনো ফাটল নেই। তবে ফিনিশিং এ ছোটখাট কিছু বিষয় আছে। সেগুলো আমরা কনসালটেন্ট ও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে বলেছি। এগুলো অল্প সময়ে সংশোধন করা যাবে।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মনির হোসেন বলেন, ওয়েট লিফটিং করে আমরা যাচাই করেছি, এগুলো গভীর কোনো ফাটল নয়। আর যেসব অসঙ্গতির কথা বলা হচ্ছে সেগুলো মেজর কিছু নয়। নির্মাণকাজের সময় নানা কারণে এই ধরনের উপরিতলে (সারফেস) ফাটল হয়, এটা স্বাভাবিক। আর এটি অবকাঠামোগত কোনো ফাটল নয়। কাজ শেষ হওয়ার আগে কোথায় কোথায় এই ধরনের ফাটল বা সমস্যা আছে, তা খুঁজে বের করে ঠিক করা হয়। এগুলো নির্মাণকাজেরই অংশ।

এ বিষয়ে অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ এবং চুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. জিএম সাদিকুল ইসলাম বলেন, নির্মাণের সময় কোনো ত্রুটির কারণে ফাটল হয়েছে। এটি নির্মাণাধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের জন্য ঝুঁকি তৈরি করবে কিনা, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে হবে। এজন্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি উচ্চতর কমিটি গঠন করা দরকার। তারপর জানা যাবে ফাটলের গভীরতা কতটুকু এবং কীভাবে এটি মেরামত করা যাবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফাটলগুলো স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। নকশার ত্রুটি ও স্পন বা পিলার দেবে যাওয়ার কারণে এই ফাটল হতে পারে। এটি কতটা ঝুঁকি তৈরি করবে কিংবা এর গভীরতা কতটুকু, তা বের করতে উচ্চতর কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। তবে কাজ শেষ না হওয়ার আগে স্প্যান ও পিলারে এমন ফাটল দেখা দেওয়ায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

৪ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নগরের লালখানবাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এলিটেড এক্সপ্রেসওয়েটি নির্মাণ করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক)। ইতোমধ্যে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মূল কাঠামোর কাজ শেষ হয়েছে। কয়েকটি র‌্যাম্প নির্মাণের কাজও শুরু হয়েছে।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটিতে থাকবে ১৪টি র‌্যাম্প। এর মধ্যে জিইসি মোড়ে একটি, টাইগারপাসে দুটি, আগ্রাবাদে চারটি, ফকিরহাটে একটি, নিমতলায় দুটি, সিইপিজেডে দুটি এবং কেইপিজেড এলাকায় দুটি র‌্যাম্প থাকবে। আর আগ্রাবাদ এলাকার চারটি র‌্যাম্পের মধ্যে জাতিতাত্তি¡ক জাদুঘর সড়কে একটি, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার সড়কে একটি এবং আগ্রাবাদ এক্সেস সড়কে হবে দুটি র‌্যাম্প।

গত বছরের ১৪ নভেম্বর এক্সপ্রেসওয়েটি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনের ছয় মাস পার হলেও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এখনও গাড়ি চলাচলের উপযোগী করতে পারেনি চউক। তবে বিদ্যুতায়নের কাজ শেষ হলে এটি যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে বলে জানান প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে একনেকে অনুমোদন হওয়ার সময় ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটি তিন বছরের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল। পরে ২০২২ সালে নকশা সংশোধন করে আরও এক হাজার ৪৮ কোটি টাকা (আগের ব্যয়ের চেয়ে ৩২ শতাংশ) ব্যয় বাড়িয়ে মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়।

২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে কাজ শুরু হলেও ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী নির্মাণ কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। সবশেষ ২০২২ সালের সংশোধিত প্রস্তাবে চট্টগ্রাম বন্দরে চলাচলকারী যানবাহনের জন্য রাস্তা উন্মুক্ত রাখতে প্রকল্পের অ্যালাইনমেন্টে পরিবর্তন করা হয়। এছাড়া বন্দরের গাড়ি সহজে চলাচলের জন্য যথাযথ ফাউন্ডেশন, সাব স্ট্র্যাকচার ও সুপার স্ট্র্যাকচার তৈরি করে নতুন নকশায় অ্যালাইনমেন্ট করার প্রস্তাব করা হয়।

১৬ কিলোমিটার উড়াল সড়কটি বিমানবন্দর এলাকা থেকে শুরু হয়ে ইপিজেড-বন্দর-বারেকবিল্ডিং- চৌমুহনী হয়ে দেওয়ানহাট রেলসেতুর পশ্চিম পাশ দিয়ে পাহাড় ঘেষে টাইগার পাস মোড়ের পর মূল সড়কের ওপর দিয়ে লালখান বাজার মোড় পেরিয়ে ওয়াসার মোড়ে আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারে গিয়ে মিলবে।

প্রকল্পটি যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড ও চীনের প্রতিষ্ঠান র‌্যাঙ্কিন। এক্সপ্রেসওয়ের মূল অবকাঠামোতে ৩৯৪টি পিলার রয়েছে। নগরের পতেঙ্গা থেকে আসা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একটি অংশ ওয়াসা মোড়ে আখতারুজ্জামান চৌধুরী ফ্লাইওভারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এর আগে লালখানবাজার এলাকায় এক্সপ্রেসওয়ের একটি র‌্যাম্প সরকারি অফিসার্স কলোনির সামনে নেমেছে। নামার র‌্যাম্প অন্তত চারটি পিলার ও স্প্যানে ফাটল দেখা দিয়েছে। পিলার নম্বরগুলো হলো পিআর-১, ২, ৩ ও আপওয়ার্ড পিয়ার বা ইউপিআর-২১।

সরেজমিন দেখা যায়, সিটি করপোরেশনের অস্থায়ী প্রধান কার্যালয়ের প্রবেশ মুখ থেকে সরকারি অফিসার্স কলোনি পর্যন্ত ফাটল পিলারের পাশে লোহার মাচা তৈরি করা হয়েছে। চারটি পিলারের প্রতিটিতে নির্দিষ্ট অংশ জিওব্যাগের কাপড় দিয়ে ঢাকা। এর মধ্যে একটি পিলারে ওঠার সিঁড়ি ছিল। তা দিয়ে ওঠে পিলারে ফাটল দেখা যায়। এ ছাড়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের অন্য পিলারগুলোতে কোনো ধরনের মাচা দেখা যায়নি।

এক নম্বর পিলারের (পিআর-১) ফাটল দেখা দেওয়া অংশের ছবি তোলা হয়। ছবিগুলো অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ ও চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) একজন শিক্ষক এবং সরকারি দুটি সংস্থায় কর্মরত দুই প্রকৌশলীকে পাঠানো হয়। তারা ছবিগুলো দেখে প্রাথমিকভাবে বলছেন, এগুলো নিশ্চিতভাবে ফাটল। নির্মাণকাজের সময় কোনো ত্রুটির কারণে এই ফাটল তৈরি হতে পারে।

দুটি পিলারের (১ নম্বর ও ইউপিআর-২১ নম্বর পিলার) ফাটল সিল করা হয়েছে। মেরামতের জন্য সিলের ওপর পোর্ট বসানো হয়েছে। তা জিওব্যাগের কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। ফাটল সিল করার ছবি একজন প্রকৌশলীর কাছে পাঠানো হলে তিনি বলেন, ফাটল মেরামতের জন্য পোর্টগুলো বসানো হয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে ইনজেকশন করে এক ধরনের আঠালো পদার্থ ভেতরে প্রবেশ করানো হবে। বিশেষজ্ঞদের দিয়ে ফাটলের আকার নির্ণয় করে তাদের সুপারিশ অনুযায়ী এটি করা প্রয়োজন।


আর্কাইভ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
১০১১১৩
১৫১৬১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭
৩০৩১