বানারীপাড়ার সেই হারিছার দায়িত্ব নিল বসুন্ধরা গ্রুপ


রাহাদ সুমন,বানারীপাড়া(বরিশাল)প্রতিনিধি॥ প্রকাশের সময় : এপ্রিল ৭, ২০২২, ১১:৫৪ অপরাহ্ণ / Print This Post Print This Post
বানারীপাড়ার সেই হারিছার দায়িত্ব নিল বসুন্ধরা গ্রুপ

৬ এপ্রিল বুধবার ও ৭ এপ্রিল বৃহস্পতিবার পাঠকনন্দিত দৈনিক কালেরকন্ঠ পত্রিকা ও অনলাইন ভার্সনে ‘মেডিক্যালে চান্স পেয়েও হারিছার চোখে অন্ধকার’ শিরোণামে একটি মানবিক প্রতিবেদন প্রকাশের পর বসুন্ধরা গ্রুপ বরিশালের বানারীপাড়ার অদম্য মেধাবী সাদিয়া আফরিন হারিছা ও তার তিন বোনের লেখাপড়াসহ দরিদ্র পরিবারটির সার্বিক দায়িত্ব নিয়েছে। পত্রিকায় ওই প্রতিবেদন দেখে ইস্টওয়েষ্ট মিডিয়া গ্রুপের পরিচালক ও প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন বসুন্ধরা গ্রুপের পক্ষে হারিছার পরিবারের দায়িত্ব নেওয়ার বিষয়ে নির্দেশনা দেন। তাৎক্ষনিক বসুন্ধরা গ্রুপের পক্ষ থেকে হারিছার পরিবারকে চাল, ডাল, আলু, তেল, সাবান, শ্যাম্পু, পিয়াজ, রশুন, চিনি, মুরগী, খেজুর, তরমুজ ও ইফতার সামগ্রীসহ নানা আইটেমের এক মাসের বাজার উপহার দেওয়া হয়।
৭ এপ্রিল বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টায় বানারীপাড়া পৌর শহরের ৪ নম্বর ওয়ার্ডে হারিছাদের বাসায় গিয়ে বসুন্ধরা গ্রুপের পক্ষ থেকে বানারীপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রিপন কুমার সাহা পরিবারের হাতে এ উপহার সামগ্রী তুলে দেন।
এসময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বানারীপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক পৌর মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম সালেহ মঞ্জু মোল্লা,বানারীপাড়া বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এটিএম মোস্তফা সরদার,উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান নুরুল হুদা,উপজেলা যুবলীগের সাবেক আহবায়ক অধ্যাপক জাকির হোসেন,আওয়ামী লীগ নেতা শাসুল আলম মল্লিক,বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারি প্রধান শিক্ষক মাকসুদা আক্তার,বানারীপাড়া প্রেসক্লাব সভাপতি ও দৈনিক কালেরকন্ঠের উপজেলা প্রতিনিধি রাহাদ সুমন,পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর গৌতম সমদ্দার,সহকারি শিক্ষক কল্লোল সরকার প্রমূখ।
এদিকে চার বোনের লেখাপড়াসহ পরিবারের সার্বিক দায়িত্ব নেওয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়া সাদিয়া আফরিন হারিছা,তার বাবা মিজানুর রহমান ও মা রাজিয়া বেগমসহ এলাকাবাসী বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান,এমডি ও ইস্টওয়েষ্ট মিডিয়া গ্রুপের পরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি অনিঃশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।
অপরদিকে হারিছা তার মাকে নিয়ে বাবার রিক্সায় চরে ৭ এপ্রিল বৃহস্পতিবার সকালে তার পুরনো বিদ্যাপিঠ বানারীপাড়া বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গেলে সেখানে এক আবেগঘন পরিবেশের অবতারনা হয়। সে প্রধান শিক্ষক আবু বকার সিদ্দিকের পা ছুঁয়ে ছালাম করে দোয়া কামনা করে। এসময় স্কুলের শিক্ষার্থীরা হারিছাকে জড়িয়ে ধরে আনন্দ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন।
এর আগে ৬ এপ্রিল বুধবার সকালে সে জাতীয় শ্রেষ্ঠ পুরস্কারপ্রাপ্ত বানারীপাড়া বন্দর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দেখা করতে গেলে সেখানেও এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
প্রসঙ্গত রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ৩০০ নম্বরের মধ্যে ২৭৮ নম্বর পেয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েও বরিশালের বানারীপাড়ার অদম্য মেধাবী সাদিয়া আফরিন হারিছার দু’চোখে অমানিশার ঘোর অন্ধকার দেখা দেয়। হারিছার চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন পূরণে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় ‘দারিদ্রতা’ নামক ‘অভিশাপ’। লেখাপড়ার ব্যয়ভার বহন করা তার রিক্সা শ্রমিক পিতার পক্ষে দুঃসাধ্য ছিল। তাইতো মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েও স্বস্তি ছিলনা হারিছার মনে। তার এ সাফল্যে দরিদ্র পিতা-মাতা উচ্ছ্বসিত হলেও মেয়ের ডাক্তারী পড়ার ব্যয়ভার বহন করা নিয়ে তাদেরকে শঙ্কা ও দুঃশ্চিন্তা তাড়া করে ফিরছিল। গল্পে গল্পে দেশজয়ী সাদিয়া আফরিন হারিছা বানারীপাড়া পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মো. মিজানুর রহমান হাওলাদার ও রাজিয়া দম্পতির তৃতীয় কন্যা । অদম্য মেধাবী হারিছা ২০১৪ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনের সুবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্ঠানে দেশের মধ্যে প্রথম ও ২০১৮ সালে জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতায় ধারাবাহিক গল্প বলায় প্রথম হয়ে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক গোল্ড মেডেল অর্জণ করে দেশজুড়ে আলোচিত ও প্রশংসিত হন। এছাড়াও সে ২০১৭ সালে ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’ শীর্ষক উপস্থিত বক্তৃতায় জাতীয় পর্যায়ে তৃতীয়,২০১৭ ও ২০১৮ সালে বরিশাল বিভাগীয় পর্যায়ে সৃজনশীল মেধা অন্বেষন প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় এবং বিএফএফ সমকাল বিজ্ঞান বিতর্ক উৎসব এবং রচনা প্রতিযোগিতায় বরিশাল বিভাগীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠত্ব ও ২০১৮ সালে জেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থী হওয়ার গৌরব অর্জন করে। হারিছা একাধিক বিষয়ে বিভাগীয় ও জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে ইতোমধ্যে বরিশাল ও বানারীপাড়াকে আলোকিত ও গৌরবান্বিত করেছে। হারিছা ৫ম শ্রেণীর সমাপনী,৮ম শ্রেণীর জেএসসি,এসএসসি ও এইচএসসির সকল পরীক্ষায় জিপিএ -৫ পেয়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছে। পড়াশুনার পাশাপাশি সে ইসলামিক জ্ঞানও অর্জন করেছে। শিক্ষার প্রতিটি স্তর সাফল্যের সঙ্গে অতিক্রম করতে তাকে দারিদ্রতার সঙ্গে নিত্য লড়াই করতে হয়েছে। তিনবেলা ঠিকমত খেতে,প্রাইভেট ও ভালো পোশাক পড়তে না পারলেও অদম্য ইচ্ছে শক্তি,ত্যাগের মনোভাব,নিরলস অধ্যবসায় ও কঠোর পরিশ্রম তার জীবনে একের পর এক সাফল্য এনে দিয়েছে। ভবিষ্যতে সে একজন মানবিক চিকিৎসক হয়ে মানবসেবায় ব্রত হওয়ার পাশাপাশি দরিদ্র পিতা-মাতার সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে চায়।
এ প্রসঙ্গে গরীবের জীর্ণ কুটিরে চাঁদের আলো হওয়া সাদিয়া আফরিন হারিছা জানায়,২০১৪ সালে সে যখন ৬ষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থী তখন তার মা গর্ভপাতজনিত কারনে গুরুতর অসুস্থ হয়ে বরিশাল হাসপাতালে ভর্তি হন। এক পর্যায়ে তাকে আইসিইউতে স্থানান্তরের প্রয়োজন হয়। কিন্তু অর্থাভাবে উন্নত চিকিৎসা ছাড়াই তার মাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়। সেই থেকে ধুকে ধুকে তার মা কোনমতে বেঁচে আছে। তার শিশুমনে তখন এ বিষয়টি গভীরভাবে নাড়া দেয়। অসুস্থ মায়ের জন্য দু’চোখে কান্নার সাতাঁর নিয়ে হারিছা তখনই সংকল্প করে সে একদিন চিকিৎসক হয়ে মানবতার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবে। কারও মাকে অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় কষ্ট পেতে দেবে না। মহান আল্লাহর কৃপায় তার সেই স্বপ্ন পূরণের পথে। সে সহ তার চার বোনের লেখাপড়া ও ৬ সদস্যের পরিবারের ভরণপোষনে রিক্সা শ্রমিক বাবার রক্ত পানি করা ঘাম জড়ানো কষ্টার্জিত উপাজর্নের কথা স্মরণ করে অশ্রুসজল হয়ে পড়া হারিছার ঐকান্তিক বিশ্বাস তার অদম্য ইচ্ছে শক্তি, নিরলস অধ্যবসায় ও কঠোর পরিশ্রমের পাশে মহান সষ্ট্রা আছেন। সে তার স্বপ্ন পূরণের জন্য সবার দোয়া কামনা করেছেন। উল্লেখ্য হারিছার বড় বোন ফারজানা আক্তার সাথী বরিশাল বিএম কলেজে এমএ ফাইনাল পর্ব,মেজ বোন শারমিন আক্তার বানারীপাড়া ডিগ্রি কলেজে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষ ও ছোট বোন হাবিবা বানারীপাড়া বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভোকেশনাল শাখায় ৯ম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত রয়েছে। হারিছাসহ তারা চার বোনই অদম্য মেধাবী। তারা যেন আধাঁর ঘরে চাঁদের আলোর মত।


আর্কাইভ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০