১৬ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ৩রা বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ || ৬ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

রাশিয়া যেভাবে বদলে গেছে যুদ্ধ শুরুর পর

আন্তর্জাতিক ডেস্ক , প্রকাশিত হয়েছে-

 

মস্কোতে কোনো গোলা এসে পড়েনা। অন্য কোনো দেশের সৈন্যরা শহরটিকে অবরোধ করে নেই। ইউক্রেনের মানুষ যে ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে তার ছিটেফোঁটাও মস্কোর লোকজনকে সহ্য করতে হচ্ছেনা।

সাদা চোখে প্রথম দেখলে মনে হবে মস্কোতে সবকিছুই স্বাভাবিকভাবে চলছে। কিন্তু আদৌ কি তা সত্য? বিবিসির জ্যেষ্ঠ সাংবাদকি ও মস্কোর বাসিন্দা স্টিভ রোজেনবার্গ মস্কোর সাম্প্রতিক অবস্থার ওপর আলোকপাতের চেষ্টা করেছেন।

শুক্রবার বিবিসিতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে স্টিভ রোজেনবার্গ বলেন, ‘নিত্যদিনের মত মস্কোর রোজ গার্ডেন রিং সড়কে যানজট। আমার ঠিক সামনে পাতাল রেল স্টেশন থেকে পিলপিল করে লোক বেরুচ্ছে।

কিন্তু বাস্তবে দুই মাস আগের তুলনায় এই শহরের কোনো কিছুকেই এখন আর স্বাভাবিক বলা যাবেনা। রাশিয়ায় স্বাভাবিক জীবন শেষ হয়ে গেছে ২৪শে ফেব্রুয়ারি – যেদিন ভ্লাদিমির পুতিন তার সেনাবাহিনীকে ইউক্রেনের ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরুর নির্দেশ দেন।’

দীর্ঘদিন ধরে মস্কোতে বরবাস করছেন রোজেনবার্গ। সেই সোভিয়েত আমল থেকেই সেখানে আছেন তিনি। বিবিসিকে এই জেষ্ঠ্য সাংবাদিক বলেন, ‘কমিউনিস্ট রাশিয়াকে আমি কাছ থেকে দেখেছি। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর রাশিয়া যে পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে গেছে তাও আমি ভেতরে বসে দেখেছি। এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই দেশটি আবার বদলাতে শুরু করেছে।’

কী কী পরিবর্তন ঘটেছে, তা সবিস্তারে বলতে গিয়ে বিবিসিকে নিজের একটি দিনের অভিজ্ঞতা শোনান রোজেনবার্গ। তিনি বলেন, ‘(গতকাল) আমি একটি সুপারমার্কেটে যাওয়ার জন্য গাড়িতে চাপলাম। অভ্যাসবশত গাড়ির রেডিও ছাড়লাম। রেডিও টিউন করা রয়েছে ৯১.২ এফএমে। একসময় এটি ছিল ‘রেডিও ইকো অব মস্কো’র তরঙ্গ—আমার সবচেয়ে প্রিয় রেডিও স্টেশন, যেখান থেকে নির্ভরযোগ্য খবর পাওয়া যায়।

‘কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহে রাশিয়ায় সব স্বাধীন মিডিয়া হয় ব্লক করা হয়েছে না হয় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন ৯১.২ এফএমে সরকারি রেডিও স্পুটনিক চলে, যেটি ইউক্রেন রুশ হামলার বড় সমর্থক।’

গার্ডেন রিং দিয়ে গাড়ি চালানোর সময়, আমি একটি থিয়েটার হলের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম এবং দেখলাম, হলের সামনে বিশাল আকারের ‘জেড’ (Z) অক্ষর ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে, যেটি এখন রাশিয়ার সামরিক অভিযানের প্রতীক।

রুশ রেলওয়ের সদর দপ্তরের বাইরেও একইরকম একটি Z স্থাপন করা হয়েছে। আমার পাশ দিয়ে একটি ট্রাক চলে গেল; সেটির গায়ে Z লেখা স্টিকার।’

রোজেনবার্গ আরও জানান, গত কয়েক সপ্তাহে ক্রেমলিনের সমালোচক বলে পরিচিত এমন বহু লোকজনের বাড়ির দরজায়, পাঁচিলে এই অক্ষর লেখা স্টিকার সেঁটে দেওয়া হয়েছে।

‘যে শপিং মলে আমি গেলাম, বেচাকেনার ভিড় তেমন নেই। বিদেশী ব্রান্ডের অধিকাংশ দোকান বন্ধ। ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর পর শত শত বিদেশী কোম্পানি রাশিয়ায় তাদের কার্যক্রম স্থগিত করেছে।’

সুপারমার্কেটে পৌঁছে রোজেনবার্গ দেখেন, সেখানে জিনিসের কমতি নেই; সমস্ত তাকই ঠাসা। গত মাসে বাজারে ভীতি দেখা দেওয়ায় চিনির যে সংকট তৈরি হয়েছিল তা কেটে গেছে বলে মনে হলো তার।

কিন্তু যত ধরণের জিনিস ক’মাস আগেও দোকানে পাওয়া যেত ততটা এখন পাওয়া যাচ্ছেনা। গত দু’মাস জিনিসপত্রের দামও বেশ বেড়ে গেছে বলে বুঝতে পারলেন তিনি।

‘শপিং মলের বাইরে আমি কথা বলছিলাম নাদেযদার সঙ্গে, যিনি পেশায় একজন ডাক্তার। তিনি আমাকে বললেন, নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্রের দাম এতটাই বেড়ে গেছে যে মাসিক বেতনে চলা আর সম্ভব হচ্ছে না নাদেঝদার।’

ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর প্রথম দিকে জনমনে যে উদ্বেগ দেখা গিয়েছিল, বর্তমানে তা কমলেও রোজেনবার্গকে নাদেঝদা জানান— এই যুদ্ধ নিয়ে সবসময়েই অপরাধবোধে ভোগেন তিনি।

‘ইউক্রেনে আসলে কী হচ্ছে সেই সত্যটি যে সমাজ জানতে চায়না তেমন একটি সমাজে বসবাস খুবই যন্ত্রণার। মানুষ তার বাড়ির মর্টগেজ দেওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন, ব্যাংক লোন শোধ নিয়ে চিন্তিত। তার আশপাশে কী ঘটছে তা নিয়ে যেন তাদের কোনো চিন্তা নেই। একজন রুশ হিসাবে আমি লজ্জিত,’ বলছিলেন নাদেঝদা।

শপিং মল থেকে আমি মস্কোর ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের দিকে রওয়ানা দিলাম যে প্রতিষ্ঠানে ৩০ বছর আগে আমি ইংরেজি পড়াতাম।

১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে কম্যুনিজমের পতনের পর এখানে আমার ছাত্ররা খুবই আশাবাদী ছিল যে এখন রাশিয়া এবং পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা এবং সহযোগিতার একটি সম্পর্ক তৈরি হবে। তারা আশা করতো তাদের ভবিষ্যৎ হবে শান্তির এবং সমৃদ্ধির।

কিন্ত বাস্তবে তা হয়নি।

‘আমরা এই সংকট কাটিয়ে উঠবো। সূর্যাস্তের পর আবারো নতুন একটি সকাল আসবে’, বলছিলেন ঐ ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউটের ছাত্র ডেনিস।

‘কিন্তু আমি আমাদের সৈন্যদের পাশে আছি। তারা আমাদের সৈনিক। যাই হোক না কেন দেশকে সমর্থন করা আমার দায়িত্ব।’

বিবিসিকে রোজেনবার্গ বলেন, ‘মস্কোতে সেদিন আমার শেষ গন্তব্য ছিল বিশাল সমর যাদুঘর যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজয় বার্ষিকী উদযাপন শুরু হয়েছে।’

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দুই কোটি ৭০ লাখ সোভিয়েত নাগরিক মারা গিয়েছিল। মাতৃভূমির জন্য রুশদের আত্মত্যাগের একটি প্রতীক হিসাবে দেখা হয় ঐ যুদ্ধকে।

কিন্তু ইউক্রেনে রাশিয়ার ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’কে যেভাবে এই যাদুঘরে তুলে ধরা হচ্ছে তা নিয়ে অস্বস্তিতে ভুগছেন রোজেনবার্গ।

তিনি জানান, যাদুঘরে ওয়েবসাইটে মিউজিয়াম শব্দটির বানান বদলে এস (s) এর জায়গায় ডেজ (Z) করে দেওয়া হয়েছে। যাদুঘরের ভেতর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কিত সুভ্যেনিরের দোকানে Z লেখা মগ বিক্রি হচ্ছে। ‘পুতিন আমার প্রেসিডেন্ট’ লেখা ব্যাজ বিক্রি হচ্ছে যেখানে প্রেসিডেন্ট শব্দটির বানানে S এর জায়গায় Z লেখা হয়েছে।

‘শুধু তাই নয় মস্কোর ঐ যাদুঘরে এখন ইউক্রেনে নাৎসিদের নিয়ে একটি বিশেষ প্রদর্শনী হচ্ছে। নাৎসিদের হাত থেকে ইউক্রেনকে মুক্ত করার মনগড়া স্লোগান দিয়েই সেদেশে সামরিক অভিযান শুরু করেছিল রাশিয়া।’

ইউক্রেনের ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ নিয়ে একটি বিকল্প সমান্তরাল আখ্যান রুশ জনগণের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে যেখানে আগ্রাসনকে চিহ্নিত করা হচ্ছে মুক্তি সংগ্রাম এবং আত্মরক্ষা হিসেবে, আর এক্ষেত্রে সরকারের সমালোচকদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে প্রচার করা হচ্ছে বলে বিবিসিকে বলেন রোজেনবার্গ।

‘আমার এখন মনে হয় যে রাশিয়াকে আমি ৩০ বছর ধরে চিনি তার অস্তিত্ব আর এখন নেই।