আবারো অস্থির ভোজ্যতেলের বাজার


নিজস্ব প্রতিবেদক প্রকাশের সময় : এপ্রিল ২৬, ২০২২, ৯:৩৪ পূর্বাহ্ণ / Print This Post Print This Post
আবারো অস্থির ভোজ্যতেলের বাজার

 

মাত্র দুই দিন আগে ইন্দোনেশিয়া সরকার পামঅয়েল রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে । এখনো সেই ঘোষণার পর দেশটিতে নতুন কোনো এলসি আটকা পড়েনি, অথচ ঢাকার বাজারে বেড়ে গেছে পামঅয়েল ও সয়াবিন তেলের দাম। অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে গতকাল সোমবার ঢাকার বাজারে প্রতি লিটার খোলা পাম বা সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে ১৮০ টাকা বা তারও বেশি দামে। যা গত সপ্তাহে ছিল ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকা।

দাম বাড়ার অজুহাত হিসেবে খুচরা ব্যবসায়ীরা সরবরাহ কম এবং পাইকারি বাজারে দাম বাড়াকে কারণ হিসেবে দেখাচ্ছেন। আর পাইকারি ব্যবসায়ীরা গণমাধ্যমে এসব বিষয়ে কথা বলতে আগ্রহী নন। অন্যদিকে আমদানিকারকরা বলছেন, ইন্দোনেশিয়া পাম তেলের রপ্তানি বন্ধ ঘোষণায় বিশ্ব বাজারে দাম বাড়ছে। যার প্রভাব বাংলাদেশের বাজারে পড়তে শুরু করেছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিত বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় ভোজ্যতেলের আমদানি পর্যায়ে শুল্ক কমানোর জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

রোজার শুরুতে ভোক্তা অধিদপ্তরে বৈঠকে আমদানিকারকরা বলেছিলেন, আগামী কয়েক মাসের জন্য অভ্যন্তরীণ বাজারে ভোজ্যতেলের কোনো ঘাটতি হবে না। তবে বাড়তি ডলারে তেল কিনতে হচ্ছে বলে দাম বাড়ছে বলে তারা সেই সময়ে দাবি করেন। যদিও বিশ^বাজারে দাম বাড়ার কারণে ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ৩০ জুন পর্যন্ত ভোজ্যতেলের আমদানি পর্যায়ে ১০ শতাংশ, উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ ও ভোক্তা পর্যায়ের ৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করেছে সরকার। এতে লিটার প্রতি কমপক্ষে ১৮ টাকা দাম কমার সম্ভাবনা তৈরি হয়।

পরে ২০ মার্চ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক সিদ্ধান্ত হয় এক লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৬০ টাকা, পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল ৭৬০ টাকা এবং প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ১৩৬ টাকা দরে বিক্রি হবে। এর দুই দিন পর ২২ মার্চ পাম তেলের দাম লিটার প্রতি ১৩০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এর ফলে দাম কিছুটা কমলেও ভোক্তাদের অভিযোগ রয়েছে, সরকার ঘোষিত দামে বাজারে সয়াবিন বা পাম তেল পাওয়া যাচ্ছে না।

এদিকে নিত্যপণ্যের অবৈধ মজুদদার এবং অসাধু সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, মাহামারির মধ্যে সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ সময়ে কেউ প্রয়োজনীয় পণ্য নিয়ে কোনো রকমের খেলা খেললে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, দেশে প্রায় ২০ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে রমজানের চাহিদা ২ দশমিক ৫ থেকে ৩ লাখ টন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হয় ২ দশমিক ০৩ লাখ টন। আমদানি প্রায় ১৮ লাখ টন। অপরিশোধিত সয়াবিন তেলর আমদানি প্রায় ৫ লাখ টন। সয়াবিন বীজের আমদানি প্রায় ২৪ লাখ টন (যা থেকে ৪ লাখ টন অপরিশোধিত তেল হয়)। অপরিশোধিত পাম অলিনের আমদানি প্রায় ১১ লাখ টন।

জানা গেছে, পাম ওয়েলের সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী ইন্দোনেশিয়ার রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের ভোজ্যতেলের বাজারে বড় ধরনের সরবরাহ সংকট তৈরির শঙ্কা রয়েছে। ভোজ্যতেল পরিশোধন ও বাজারজাতকারী কোম্পানিগুলো বলছে, আমদানি নির্ভর এ পণ্যটির বিশ্ববাজার থেকে সরবরাহ পাওয়া না গেলে স্থানীয় বাজারেও এর ঘাটতি দেখা দেবে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, আমদানিনির্ভর ভোজ্যতেলের বাজারে ৪৬ দশমিক ৩ শতাংশ সয়াবিন ও ৫৩ দশমিক ৭ শতাংশ পাম ওয়েলের ব্যবহার হয়। পাম ওয়েলের আমদানির প্রায় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশেই আসে ইন্দোনেশিয়া এবং বাকি ২০ বা ৩০ শতাংশ আসে মালয়েশিয়া থেকে। ইন্দোনেশিয়া সরবরাহ বন্ধ করে দিলে বিশ্বব্যাপী একটা সংকট তৈরি হবে।

ভোজ্যতেল পরিশোধন ও বাজারজাতকারী কোম্পানি মেঘনা গ্রুপের সিনিয়র এজিএম তাসলিম শাহরিয়ার বলেন, বিশ্ববাজারে এককভাবে ইন্দোনেশিয়া পাম ওয়েলের রপ্তানি করে ২৫ শতাংশ। হঠাৎ করে রপ্তানি বন্ধ হওয়ায় বিকল্প খাতে চীন ও ভারতের মতো প্রতিযোগী দেশের আগ্রহ বেশি থাকবে। ফলে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত দামে বিকল্প বাজার থেকে তেল কিনতে হবে, যার প্রভাব অভ্যন্তরীণ বাজারে পড়বে।

তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লেও দেশের বাজারে সরবরাহ ঠিক রেখেছে মিল মালিকরা। তবে যত দ্রুত সম্ভব দাম সমন্বয় করা জরুরি। ব্যবসায়ীরা লোকসান দিয়ে পণ্য আমদানি করবে না।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মাওলার সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানিয়েছেন, ভোজ্যতেলের বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করবেন না।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ব্লুমবার্গের এক খবরে বলা হয়েছে, ইন্দোনেশিয়া তাদের অভ্যন্তরীণ ভোজ্যতেলের সমস্যা সমাধানে পাম ওয়েলের রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। দেশটি বিশ্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশ ভোজ্যতেল সরবরাহকারী। এর আগে ভোজ্যতেলের মধ্যে সানফ্লাওয়ার অয়েলের (সূর্যমুখী তেল) সরবরাহকারী দেশ ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়া যুদ্ধের কারণে পণ্যটির সরবরাহ আগেই বন্ধ হয়ে গেছে।

সার্বিক বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত সচিব এবং জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ভোজ্যতেলের বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং ভোক্তা অধিদপ্তর যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার সুফল ইতোমধ্যে ভোক্তা ও ব্যবসায়ীরা পাচ্ছেন। এখন নতুন সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে পাম ওয়েলের পাশাপাশি, সানফ্লাওয়ার অয়েলের আমদানি শুল্ক প্রত্যাহারের বিষয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বিকল্প বাজার থেকে সয়াবিন ও পাম তেল আমদানির জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে।

নতুন করে ভোজ্যতেলের বাজারে যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, তা নিয়ন্ত্রণে ভোক্তা অধিদপ্তর কী ধরনের উদ্যোগ নেবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী অবৈধ মজুদদার এবং অসাধু সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। অতএব, বাজার নিয়ন্ত্রণে যা করা দরকার বা কঠোর হওয়া দরকার আমরা তা করব।


আর্কাইভ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০