আমতলীতে বেকার যুবক রাসেলের বিষমুক্ত কুল চাষে বাজিমাত


হায়াতুজ্জামান মিরাজ, আমতলী (বরগুনা) প্রতিনিধি প্রকাশের সময় : ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৩, ৭:১৪ অপরাহ্ণ / Print This Post Print This Post
আমতলীতে বেকার যুবক রাসেলের বিষমুক্ত কুল চাষে বাজিমাত
dav

 

বরগুনার আমতলী উপজেলার গুলিশাখালী ইউনিয়নের বাইনবুনিয়া গ্রামে বিষমুক্ত কুল চাষ করে বাজিমাত করেছেন রাসেল নামে এক বেকার যুবক। ৫ একর জমিতে কাশ্মিরী আপেল কুল, বাওকুল, বলসুন্দরী ও ভরতসুন্দরী নামে ৪ জাতের কুল চাষ করে চলতি বছর প্রায় ১০ লাখ টাকা আয়ের স্বপ্ন দেখছেন।

রাসেলের উৎপাদিত কুল ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রি হচ্ছে। এক সময়ের বেকার যুবকের এমন সাফল্যে সারা ফেলেছে এলাকায়। প্রতিদিন তার বাগান দেখতে দূর-দুরান্ত লোকজন ছুটে আসছে। তার এ সাফল্য দেখে অন্য বেকার যুবকরাও ঝুকছেন কুল চাষে।

উপজেলার গুলিশাখালী ইউনিয়নের গোজখালি এলাকার বেকার যুবক আবু বক্কর সিদ্দিক রাসেল। কাজ করতেন ওয়ার্ল্ডফিস নামের একটি বে-সরকারি উন্নয়ন সংস্থায়। ঢাকার সরকারী বাংলা কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অর্নাসসহ এমএ এবং বে-সরকারী প্রাইম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি করা রাসেল ২০২০ সালের করোনা পরিস্থিতিতে ওই উন্নয়ন সংস্থার প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে বেকার হয়ে পড়েন। বেকারত্ব থেকে মুক্তি পেতে কৃষি ক্ষেত্রে কিছু করা যায় কিনা রাসেল তা নিয়ে ভাবতে থাকেন। পরে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার সাথে আলাপ করেন এবং তার পরামর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে নেমে পড়েন কৃষি কাজে। কিন্তু নিজেদের পর্যাপ্ত জমি না থাকায় প্রতিবেশীর ৫ একর জমি বার্ষিক চুক্তিতে ইজারা নিয়ে সেটি উঁচু করে শুরু করেন মাল্টার চাষ। কিন্তু সুবিধা করতে পারেননি। লোকসানে পড়তে হয় তাকে। এতে কিছুটা মনোবল হারিয়ে ফেলেন রাসেল। কেটে যায় একটি বছর। ২০২১ সালের উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শে এবং ইউটিউব দেখে এবার তিনি নেমে পড়েন কুল চাষে। শুরুতে কুষ্টিয়ার মেহেরপুর এলাকার একটি বাগান থেকে সংগ্রহ করেন কাশ্মিরী আপেল কুল, বল সুন্দরী ও ভরত সুন্দরী প্রজাতির কুল গাছ। গাছগুলো রোপনের পর নিজেই পরিচর্যা শুরু করেন। সঠিক পরিচর্যায় গাছগুলো বেড়ে উঠে এবছর ফল ধরেছে সকল গাছে।

dav

২০২২ সালে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং এ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরেও গাছে গাছে শুধু দুলছে লাল আভা ছড়ানো থোকায় থোকায় কুল। পাকতে শুরু করেছে সপ্তাহ দুয়েক আগে থেকে। বিক্রিও শুরু করেন তিনি। আকার, স্বাদে ভালো হওয়ায় বাজারে রাসেলের বাগানের কুলের চাহিদাও খুব বেশী। প্রথমে তিনি আমতলীসহ আশেপাশের জেলা শহরের বাজারে ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি শুরু করেন। এখন রাসেল রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীদের কাছে ১০০ টাকা দরে কুল বিক্রি করছেন।

 

এরমধ্যে কিছু কুল গাছ বারোমাসি ফলন দেয় আবার কিছু মৌসুম ভিত্তিক। ফলে সারা বছই তার বাগানে কুল পাওয়া যায়। মৌসুম ভিত্তিক গাছগুলোতে দু’মাস আগে থেকে পাকতে শুরু করে কুল। এবছর কম করে হলেও দশ টন কুল বরই উৎপাদন হয়েছে তার বাগানে। এতে তিনি আয় করবেন প্রায় ১০ লাখ টাকা।

 

শনিবার সকালে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, রাসেলের বাগান জুরে গাছে ভরা কুল। বাগানের কোথাও একটু পা ফেলার জায়গা নেই। সাড়ি সাড়ি গাছে লাল আভা ছড়ানো থোকায় থোকায় দুলছে লাল কাশ্মীরী কুল। অনেক গাছ কুলের ভাড়ে মাটি ছুয়ে লেপ্টে আছে। লাল সাদা আর মেরুন রঙ্গের বাহারি ফলে ভরে গেছে বাগান। রাসেলসহ তার বাগানে কর্মরতরা ব্যাগ ভর্তি করে বিক্রির জন্য গাছ থেকে সংগ্রহ (ছিরছেন) পাকা কুল। পাখির ছোবল থেকে কুল রক্ষার জন্য পুরো বাগানের আকাশ জুরে টানিয়ে দেয়া হয়েছে জাল। এ যেন এক মনোরম দৃশ্য। বাগানের ভিতরের টোংঘরে কুল কেনার জন্য অপেক্ষা করছেন দুর-দুরান্ত থেকে আসা পাইকারি ক্রেতারা। এছাড়াও প্রতিদিন রাসেলের কুল বাগান দেখতে দুর-দুরান্ত থেকে অনেক দর্শনার্থীরা ভীর করছেন।

 

এসময় কথা হয় বাগান মালিক আবু বক্কর সিদ্দিক রাসেলের সঙ্গে। তিনি জানান, চাকরি চলে যাওয়ার পর বেকার হয়ে পড়ি। ভাবছি কি করবো। ইউটিউব এবং আমতলী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সিএম রেজাউল করিম স্যারের পরামর্শে প্রতিবেশীর ৫ একর জমি ইজারা নিয়ে কুল চাষ শুরু করি। প্রথমে প্রতিকূলতা থাকলেও এখন গ্রামের সবাই আমাকে সহযোগিতা করে। বাগানে বর্তমানে আপেল কুল, কাম্মিরী কুল, বলসুন্দরী কুল ও বাউকুল রয়েছে। ফলন দেখে আমি খুব খুশি। তিনি আরো বলেন, প্রথমে মালটা চাষ করতে গিয়ে কিছুটা লোকসান হলেও এখন কুল চাষ করে আমি তা পুষিয়ে সফল হয়েছি। মৌসুম শুরু থেকেই স্থাণীয় ও দূর-দুরান্তের পাইকারি ব্যবসায়ীরা আমার বাগান থেকেই কুল (বড়ই) কিনে নিয়ে যান। বর্তমানে আমার বাগানের বিষমুক্ত কুল উৎপাদনের খবর ছড়িয়ে পড়ায় এখন প্রতিদিনই বাগান থেকে রাজধানী ঢাকা, বিভাগীয় শহর বরিশাল ও পটুয়াখালীসহ বিভিন্ন জেলা থেকে এবং স্থাণীয় পাইকারী ফল ব্যবসায়ীরা কুল কেনার জন্য ভীর করছেন। প্রতিদিন বাগান থেকে ৩ থেকে ৪ মন কুল সরবরাহ হচ্ছে বিভিন্ন ব্যবসায়ীর ও পাইকারদের নিকট।

 

রাসেল আরো জানান, তার বাগানের কুল বিষমুক্ত। গাছে ফুল আসার পর প্রথম একবার নিম পাতা থেকে উৎপাদিত জৈব বালাইণাশক ব্যবহার করেছি। আর কোন ধরনের কীটনাষক ব্যবহার করা হয়নি। এজন্য আমার বাগের কুলের চাহিদা অনেক বেশী।
রাসেল আরো জানান, বর্তমানে তার বাগানে ৩জন বেতনভূক্ত কর্মচারী রয়েছে। তারা প্রতিদিন ৫শ’ টাকা করে বেতন পান। বাগান বড় করে আরো লোকের কর্মসংস্থান করতে চান রাসেল। আগামী বছর থেকে তিনি তার বাগানের কুল কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা বিক্রির আশা করছেন।

বেকার যুবক রাসেলের সাফল্য দেখে এলাকার আব্দুল আওয়াল ওরফে খোকন মৃধা, হানিফ মৃধা, আল আমিন খান, হারুন মৃধাসহ কয়েকজন বেকার যুবক নেমে পড়েছেন কুল চাষে। কোন সমস্যা হলে বা ভালো ফলনের জন্য তারা অনেকেই এখন রাসেলের সহায়তা নিয়ে থাকেন। এসব উদ্যোক্তাদের বাগানে আগামি বছর থেকে কুল (বড়ই) উৎপাদন শুরু হবে।

আমতলী উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা সিএম রেজাউল করিম মুঠোফোনে বলেন, আবু বক্কর সিদ্দিক রাসেল চাকুরি হারিয়ে একসময় বেকার হেয়ে পড়েছিল। আমাদের পরামর্শে সে বিষমুক্ত কুল (বড়ই) বাগান তৈরি করে সে এখন স্বাবলম্বী। কোন ধরনের রাসায়নিক সার বা কিটনাশকের ব্যবহার না থাকায় এবং তার বাগানে উৎপাদিত কুলের আকার ও স্বাদ ভালো হয়েছে। এ কারনে বাজারে তার কুলের চাহিদাও বেশি। বেকার যুবক রাসেলই প্রথম ওই এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে কুল চাষ শুরু করেন। তারে সাফল্য ওই এলাকায় আরো অনেক বেকার যুবকরা কুল চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। এতে অনেক বেকার যুবক নিজেদের কর্মসংস্থান তৈরি করতে সক্ষম হচ্ছে।

 

SK24/SMK/DESK


আর্কাইভ