মান্তা নারীর সংগ্রামী জীবন

নদীতে নৌকায় মিনুর জীবনযুদ্ধ


এম.এ হান্নান, বাউফল প্রতিনিধি প্রকাশের সময় : মার্চ ৭, ২০২৩, ৬:৩৫ অপরাহ্ণ / Print This Post Print This Post
নদীতে নৌকায় মিনুর জীবনযুদ্ধ

 

নিত্যদিনের মত জীবিকার খোঁজে ছুঁটে এসেছেন তেঁতুলিয়ায়। মাথার ওপরে ঝলসানো রোদ। নদীর জলে দুলছে নৌকা। চোখে মুখে হতাশার ছাপ। মলিন মুখে নিখুঁত হাতে নদীতে জাল ফেলছেন মান্তা নারী মিনু (৬০)। স্রোতের টানে আপন গতিতে চলছে নৌকা। ছোট্ট হাতে বৈঠা ধরে আছে এক কিশোরী। আবার বৈঠা ছেড়ে জালও ধরেন ছোট হাতে। ওই কিশোরীর নাম আসমা। বয়স ১২। আসমা মিনুর ছোট মেয়ে। এই বয়সে তার স্কুলে থাকার কথা থাকলেও জীবিকার সংগ্রামে নাম লেখাতে হয়েছে তাঁকেও।

ঘড়ির কাটার হিসেব না জানলেও মান্তা পল্লীর এই কিশোরী জোয়ার ভাটা দেখে মাছ ধরার সময় হিসেব করতে পারে। তেঁতুলিয়া নদীর বুকে ঘুরে ঘুরে জাল ফেলছেন মা- মেয়ে। জোয়ার শেষে জাল তুলতে ঘাটে ফিরবে তারা। ভাগ্যের জালের মাছ বিক্রির টাকায় আগুন জ্বলবে চুলায়। এভাবেই নদী নৌকায় সংগ্রাম করে জীবন চলে মান্তা নারী মিনুর।

 


জীবন যুদ্ধে আপোষহীন মিনারা বেগম ওরফে মিনু জানান, তারা মা বাবাও ছিলেন মান্তা। জন্মের ২বছরের মাথা মা আনোয়ারা বেগম ও ৫বছরের মাথায় বাবা মোসলেম সরদার মারা যায়। মা বাবা হারা মিনু চাচা নুরু সরদারের নৌকায় বেড়ে ওঠেন। বুঝতে পারার পর থেকেই চাচা চাচির সাথে নৌকা মাছ ধরার কাজ করতেন। মাত্র ১৩বছর বয়সে বিয়ে হয় তার। বছর না ঘুরতেই কোলে আসে প্রথম সন্তান। একে একে কোল জুড়ে আসেন ৯ সন্তান। তিন ছেলে ও তিন মেয়েরও বিয়ে হয়েছে। তারাও ভাসমান। নদীতে মাছ ধরে। ভিন্ন নৌকায় বসবাস করে তারা। স্বামী আনছার হোসেন ওরফে আনছু সরদার , এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তাদের সংসার। বছরের পর নৌকায় কেটে যাচ্ছে তাদের জীবন। তেঁতুলিয়া নদীর ঝড়-ঝাপটার সাথে লড়াই করে চলছে জীবন যুদ্ধ।

ক্ষোভে প্রকাশ করে মিনারা বেগম মিনু বলেন,‘ আমাগো ঘর বাড়ি নাই, নৌকায় থাকি। মাছ ধরে খাই। উপরে যারা থাকে তারা সব পায়, আমাগো সরকার কিছু দেয় না। হুনছি সাতাইটা ঘর দিবে, হ্যার মধ্যে আমাগো নাম নাই।

 

শুধু মিনু এক নয়, পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার কালাইয়া ইউনিয়নের বগী খালে নৌকায় বসবাস করা দুই প্রায় অর্ধশত মান্তা নারীর চলে নদীতে সংগ্রাম। প্রায় ৫০ বছর ধরে বংশ পরম্পরায় বগী খালে অর্ধশতাধিক নৌকায় প্রায় দুই শতাধিক নারী পুরুষ ও শিশু ভাসমান জীবন যাপন করে আসছে। সমাজে তাদের পরিচয় মান্তা সম্প্রদায়। এদের হাতে খোনা কয়েকজনের ঘর বাড়ি থাকলেও অধিকাংশ পরিবারের নেই ঘর বাড়ি,জায়গা জমি। জন্ম মৃত, জীবন জীবিকা, সুখ দুঃখ সব কিছুতে মিশে আছে নৌকা।

এই মান্তা পল্লীতে জন্ম নেওয়া সকল শিশুকে বুঝতে পারার পর থেকেই হাত মেলাতে হয় পরিবারের উপাজংনের কাজে। স্কুল, বই, খাতা, কলম, পড়াশুনা, মান্তা পল্লীর শিশুদের কাছে রূপকথার গল্পের মত। তারা জানে তাদের বয়সি শিশুরা পড়াশুনা করে। স্কুল মাদ্রাসায় যায়। তবে তারা সেখানে যায় না। ভাগ্য তাদের নেয়ও না।

 


রীতি অনুযায়ী মান্তা পল্লীর ১২ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। পত্রও কোনো না কোনো মান্তার সন্তান। বিয়ের পরে নতুন নৌকায় নতুন করে শুরু সংগ্রামী জীবন। মান্তা পল্লীর নারীদের বিনোদন বলতে অবসরে রান্না করে পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসাথে খাওয়া আর ঘুম। আর উৎসব বলতে নিজেদের সম্প্রায়ের মধ্যে বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তের মান্তা পল্লীর কন্যা জায়া ও জননীদের এই সংগ্রামী জীবনের পাশে দাঁড়ায়নি কোনো সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।

কালাইয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এস.এম ফয়সাল আহম্মেদ জানান, মান্তা পল্লীর সবাই কালাইয়া ভোটার নয়। যারা কালাইয়া ভোটার তাদেরকে সরকারি সাহায্য সহযোগিতা দেওয়া হয়। আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরের জন্য ইউএনও অফিসে তালিকা দেওয়া হয়েছে।


মান্তা পল্লীর নারীদের উন্নয়নে উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে করনীয় জানতে উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারময়্যান মরিয়ম আক্তার নিসুর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, বিষয়টি আমাদের নজরে রয়েছে, উপজেলা পরিষদের মাসিক সমন্বয় সভায় আমরা বিষয়টি তুলে ধরে কি কি করনীয় তা নির্ধারন করবো যাতে করে মান্তা পল্লীর নারীদের জীবন মান উন্নয়নে আমরা সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারি।’
উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা (অ.দা.) জেসমিন আকতার বলেন,‘ পিছিয়ে পড়া মান্তা পল্লীর নারীদের সচেতনা বৃদ্ধি ও জীবন মান উন্নয়নে খুব শীঘই কর্মশালার পাশাপাশি প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করবো।

এবিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. আল আমিন বলেন, মান্তা পল্লীতে বসবাসরত জনগোষ্ঠীকে মূলস্রোতে নিয়ে আসার জন্য তাদেরকে মেইন ল্যান্ডে পূনর্বাসনের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে ২৭টি পরিবারকে সরকারি ভাবে পাকা ঘর দেওয়া হবে। ব্যবস্থা করা হবে। বাকিরাও পর্যায়ক্রমে ঘর পাবে।

 

SK24/SMK/DESK


আর্কাইভ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০৩১