জমিসহ পাকা ঘর পেয়ে বদলে গেছে ওঁদের জীবন


রাহাদ সুমন,বিশেষ প্রতিনিধি॥ প্রকাশের সময় : মার্চ ২১, ২০২৩, ৮:৫৭ অপরাহ্ণ / Print This Post Print This Post
জমিসহ পাকা ঘর পেয়ে বদলে গেছে ওঁদের জীবন

পৌর শহর থেকে দক্ষিণে প্রায় দুই কিলোমিটার পিচঢালা পথ পেরোলে দরবেশ মেছের মাঝির (রা.) পূণ্যভূমি বানারীপাড়া উপজেলার আলতা গ্রামে আশ্রয়ণে সারি সারি সেমি পাকা রঙিন ঘর। দূর থেকে দেখলে মনে হয় সেমি পাকা এ ঘরগুলোর টিনের চালা যেন ‘লাল-সবুজের’ পতাকা। এর এক পাশে রয়েছে সন্ধ্যা নদীর শাখা বৃহৎ আকারের খাল আর অপর পাশে পিচঢালা পথ। খালের তীরে বাড়িগুলোর সামনে শোভা পাচ্ছে নানা ফুল-ফলের বাগান। রয়েছে নানারকম শাক-সবজির সবুজের সমারোহ। রঙিন টিনের আধাপাকা ঘরগুলো দেখলে মন জুড়িয়ে যায়। এ যেন এক খন্ড শান্তির নীড়। এই নীড়েই সুখের স্বপ্ন গড়েছেন সহায়-সম্বলহীন এক দল নারী-পুরুষ। খাল ও সড়কের গা ঘেঁষে গড়ে ওঠা আশ্রয়ণ প্রকল্পের এই পল্লীতে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ১২৩।

জনসংখ্যার হিসাবে এখানে ৫ শতাধিক নারী-পুরুষের বসতি। শুরুতে মাটির ভিটায় কাঠ ও বাঁশের বেড়া আর ওপরে টিনের ছাউনি দিয়ে তৈরি ১০টি ঘরে বসবাস শুরু হলেও এখন এখানে ভূমিহীনদের জন্য নির্মিত প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ১২৩ ঘরেই শান্তির বসবাস তাদের। হাঁস-মুরগি, গবাদি পশু পালন ও সবজির বাগানসহ নানা উপায়ে স্বাবলম্বী এ মানুষগুলো। শিক্ষার ছোঁয়াও লেগেছে তাদের মধ্যে। এখানকার অর্ধশত ছেলেমেয়ে পড়ালেখা করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে।

২০ মার্চ সোমবার বসন্তের স্নিগ্ধ সকালে সরেজমিনে এ আশ্রয়ণে গিয়ে দেখা যায়, মৃদুমন্দ বাতাসে খালের পাড়ে ঘরের আঙিনার গাছে ঢেঁড়শ ও মরিচের নাচন। পাশের মাচায় লকলকিয়ে বাড়ছে সিম আর লাউ,নিচের গাছে ঝুলছে ছোট ছোট বেগুন ও লাল-সবুজ টমেটো। রয়েছে পেপে ও মিষ্টি কুমড়া সহ নানা সবজি। গাছে গাছে আমের মুকুল জানান দিচ্ছে শীতকে বিদায় জানিয়ে বসন্তের আগমন। নারকেল, সুপারী, আমড়া, চিনা বাদাম, পেয়ারা ও মাল্টাসহ নানা জাতের ফলের বাগান দিন দিন এ পল্লীকে সমৃদ্ধ করছে। এর পাশেই সুবাস ছড়াচ্ছে গাছের বাহারী রঙিন ফুল। রয়েছে হাস-মুরগি আর গবাদী পশুর খামার। এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে খেলছে শিশু-কিশোরের দল।

পুরুষরা ছুটছেন দৈনন্দিন কাজে। নারীদের কেউ কেউ ব্যস্ত হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগলের খামার আর নিজ আঙিনায় গড়ে তোলা সবজি বাগানের পরিচর্যা নিয়ে। আবার কেউবা ব্যস্ত কাগজের মোড়ক (ঠোঙ্গা) তৈরী ও সেলাইয়ের কাজে। ক্ষুদ্র দোকানও ঘরে তুলেছেন কেউ কেউ। এক কথায় ছোট পরিসরে আদর্শ রঙিন ছিমছাম সারি সারি ঘর। আর সেই সুখনিলয়ের আঙিনায় সবজি খেতে কাজ করছিলেন শেফালী মন্ডল (৭০) নামের এক বিধবা বৃদ্ধা। এক পর্যায় তিনি ঘরের বারান্দায় কাগজের মোড়ক তৈরী করতে বসেন। ১৫ বছর আগে স্বামী জ্ঞানেন্দ্রনাথ মন্ডলের মৃত্যুর পর একমাত্র ছেলে দিলীপকে নিয়ে তিনি পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলা থেকে জীবন-জীবিকার তাগিদে বানারীপাড়ায় আসেন। পৌর শহরের ১নং ওয়ার্ডে কুন্ডু বাড়িতে ভাড়া বাসায় থেকে মা-ছেলে মিলে কাগজের মোড়ক তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। জমিসহ সুন্দর পাকা ঘর করে দেওয়ায় মমতাময়ী মা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করেন তিনি।

আরেক বাসিন্দা শাহীন শিকদারের স্ত্রী সাথী (৩২) জানান, এর আগে তারা পৌর শহরের ৪নং ওয়ার্ডে ভাড়া থাকতেন। মনোরম পরিবেশে জমিসহ রঙিন পাকা ঘর পেয়ে তারা আবেগ আপ্লুত। শহিদ খলিফার স্ত্রী ঝুমুর (৩০) জানান, এর আগে তারা পৌর শহরের ৩নং ওয়ার্ডে বসবাস করতেন। পিঠা বিক্রি করে তারা জীবিকা নির্বাহ করেন। নদীগর্ভে বাড়িঘর বিলীন হওয়ায় তারা পিরোজপুরের পাড়েরহাট থেকে এখানে পাড়ি জমান। প্রমনেন্দ হালদার (৭০) জানান, তিনি পেশায় কাঠমিস্ত্রী। তিনি আগে বানারীপাড়া সদর ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড মাছরং গ্রামে বসবাস করতেন। তিনি জানান, এখানের পরিবেশ অনেক ভালো, শুধু জমিসহ ঘরই নয় ফ্রি বিদ্যুৎ সংযোগ, রান্না ঘর, স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করাসহ নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আমাদের জীবনকে মধুময় করায় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আমরা চিরকৃতজ্ঞ।

তপন বিশ্বাসের স্ত্রী পপি বিশ্বাস (৩০) প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর পেয়ে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন, আগে আমরা এখানেই ছোট ভাঙ্গা ঘরে থেকে শিশু সন্তান নিয়ে শীত-বৃষ্টি মৌসুমে লড়াই করে অনেক কষ্টে জীবন যাপন করতাম। সরকার আমাদের নতুন ঘর দেয়ায় এখন আমরা পরিবার পরিজন নিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারছি। আগের মত কষ্ট আর নেই। স্থানীয় এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে স্বামীকে মাছ শিকারের জাল কিনে দিয়েছি। নদীতে মাছ শিকার করে আবার কখনও পানের বরজে কাজ করে তাদের সংসার চলছে। তিনি আরো জানান, আমরা এখানের পুরনো বাসিন্দা। পূর্বে এখানে ১২/১৩ বছর আগে ১০টি টিন-কাঠের ঘর ছিলো। তখন থেকেই এখানে আমরা ১০টি পরিবার বসবাস করে আসছি। বিধবা হাসিনা বেগম (৬০) জানান, আমরা উপজেলার বাইশারী ইউনিয়নের বৌসেরহাট গ্রাম থেকে এসেছি। বাড়িঘর সব সন্ধ্যা নদীগর্ভে বিলীন হওয়ায় এখানে একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই হলো। একই ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ড উত্তরকুল গ্রাম থেকে এসেছেন সিদ্দিকুর রহমান (৬৫)। তিনি এর আগে পৌর শহরের ৩নং ওয়ার্ডে বসবাস করতেন। দু’শতক জমিসহ ঘর পেয়ে তিনি উচ্ছ্বসিত।
সুন্দরী বেগম নামের ষাটোর্ধ্ব নারী জানান, বঙ্গবন্ধুর মেয়ে শেখ হাসিনা আমাগো মাথা গোঁজার ঠাই এ শান্তির নীড় গড়ে দেওয়ায় মহান আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানাই তাঁকে যেন একশ’ বছর সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রেখে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে রাহেন।

এভাবেই এই সুখের পল্লীতে সুখে আছেন ১২৩টি পরিবারের ৫শতাধিক শিশু ও বৃদ্ধসহ নারী-পুরুষ। মুজিব জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে গৃহীত এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে অসহায় ভিক্ষুকরাও পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর উপহারের এই ঘর। এসব প্রকল্প ঘুরে দেখা গেছে, হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি ঘরে মিলেমিশে আছে। দিন যতই যাচ্ছে একে অপরের সুখ-দুঃখের সঙ্গীও হচ্ছে। এ যেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

জেলা প্রশাসনের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় গৃহহীন-ভূমিহীনরা স্বপ্নের এ পাকা ঘরগুলো পেয়েছেন। এতে করে এই অসহায় মানুষগুলোর জীবনমান বদলে গেছে। এই মানুষগুলোর একসময় ছিলোনা নিজস্ব কোন স্থায়ী ঠিকানা। খাস জমি কিংবা অন্যের জমিতে আশ্রয় নিয়ে ভাঙ্গা ঘরে আবার কেউ স্বল্প টাকার ভাড়া বাসায় থেকে পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতেন তারা। প্রধানমন্ত্রীর এই বিশেষ উপহারের বাসস্থানসহ নানাবিধ সুবিধার ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে তাদের জীবনমান। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপহারের এই ঘর অনাবিল হাসি ফুটিয়েছে তাদের মুখে। নিজের একটি পাকা-পরিচ্ছন্ন ঘরে থাকার আজন্ম লালিত স্বপ্ন পূরণ হয়েছে তাদের মনোরম পরিবেশে নিরাপদ ও মজবুত স্থায়ী ঘর পেয়ে। সরেজমিনে এসব ঘরে বাস করা মানুষদের দেখা যায়, মানবেতর জীবনমান থেকে মুক্তি পেয়ে এখন তারা সুখ-স্বাচ্ছন্দে পরিবার পরিজন নিয়ে জীবন যাবন করছেন।

এদিকে আগামীকাল ২২ মার্চ বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি বানারীপাড়া পৌর শহরের ১ নম্বর ওয়ার্ডের চতুর্থ পর্যায়ের আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৮৭ টি ঘরসহ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের মোট ১৪২টি জমিসহ সেমি পাকা ঘর হস্তান্তরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন। ফলে এ নিয়ে উপকারভোগীসহ গোটা উপজেলার মানুষের মাঝে ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দিপনা বিরাজ করছে। পৌর শহরের ১ নম্বর ওয়ার্ডে সন্ধ্যা নদী ও এর শাখা খালের তীরে মনোরম পরিবেশে গড়ে তোলা আশ্রয়ণ প্রকল্পে প্রধানমন্ত্রীর এ ভার্চুয়ালি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রশাসনিক প্রস্তুতি চলছে। ইতোমধ্যে বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার আমিন উল আহসান ও জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে নতুন এ আশ্রয়ণ প্রকল্প পরিদর্শন করে গেছেন।

এ প্রসঙ্গে বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার মো. আমিন উল আহসান বলেন, পিছিয়ে পড়া মানুষদের সবার আগে সেবা প্রদানের এ আশ্রয়ন প্রকল্প সারা বিশ্বে ‘অর্ন্তভূক্তিমূলক শেখ হাসিনা মডেল’ হিসেবে পরিচিতি ও গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপহারের জমিসহ এই পাকা ঘর অনাবিল হাসি ফুটিয়েছে অসহায় মানুষের মুখে। আশ্রয়নে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিসহ সব ধরনের সহায়তা ও পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরকেও আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তুলতে নানা ধরনের প্রশিক্ষণ ও পরামর্শও দেওয়া হচ্ছে।

এ বিষয়ে বরিশাল জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন,বানারীপাড়ার সন্ধ্যা ও এর শাখা নদীর তীরে মনোরম পরিবেশে আশ্রয়নে ২ শতক জমিসহ সেমি পাকা ঘরগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। গৃহহীন-ভূমিহীনরা জমিসহ স্বপ্নের এ পাকা ঘর পাওয়ায় এই অসহায় মানুষগুলোর জীবন বদলে গেছে। এই মানুষগুলোর একসময় ছিলোনা নিজস্ব কোন স্থায়ী ঠিকানা। তারা মানবেতর জীবনযাপন করতেন। প্রধানমন্ত্রীর এই বিশেষ উপহারের বাসস্থানসহ নানাবিধ সুবিধার ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে তাদের জীবনমান ।
এ বিষয়ে বানারীপাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ¦ গোলাম ফারুক বলেন, মাদার অব হিউম্যানিটি প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনা ২২ মার্চ বানারীপাড়া উপজেলাকে শতভাগ ভূমি ও গৃহহীন মুুক্ত উপজেলা হিসেবে ঘোষণা করবেন। উপকারভোগীসহ বানারীপাড়াবাসীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রীর ভার্চুুয়ালি এ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে ঘিরে এলাকায় উৎসবমূূখর পরিবেশ বিরাজ করছে। এলাকাবাসীর মাঝে সৃষ্টি হয়েছে ব্যপক উৎসাহ ও উদ্দিপনা। সেই মাহেন্দ্রক্ষনের জন্য বানারীপাড়াবাসী এখন উন্মূখ হয়ে আছে।

এ প্রসঙ্গে বানারীপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফাতিমা আজরিন তন্বী বলেন, ‘দেশের একজন মানুষও ভূমিহীন ও গৃহহীন থাকবেনা’- মুজিব জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন ঘোষণা বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে বানারীপাড়া উপজেলা প্রশাসন। বানারীপাড়ায় সদর ইউনিয়নের আলতার এ আশ্রয়ণসহ উপজেলার ৮ ইউনিয়নে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপহার আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের আওতায় ২০২০-২১ অর্থ বছরে মোট ৩৮০টি পরিবারের জন্য সেমি পাকা ঘর নির্মাণ ও হস্তান্তর করা হয়েছে। এসব আশ্রয়নে বসবাসকারী উপকারভোগীদের জীবনমান আমূল বদলে গেছে। আগামী জুন মাসে বানারীপাড়া উপজেলাকে শতভাগ ভূমিহীন ও গৃহহীন মুক্ত করার মানসে কাজ চলছে। ২২ মার্চ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভার্চুয়ালি উদ্বোধনের মাধ্যমে পৌর শহরের ১ নম্বর ওয়ার্ডসহ উপজেলার বাইশারী,সলিয়াবাকপুর ও ইলুহার ইউনিয়নে ৪র্থ পর্যায়ে নির্মিত জমিসহ আরও ১৪২টি সেমি পাকা ঘর উপকারভোগীদের মাঝে হস্তান্তর করবেন বলেও জানান তিনি।


আর্কাইভ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০৩১