ব্যাংকে বেড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত


নিজস্ব সংবাদদাতা প্রকাশের সময় : মার্চ ৩০, ২০২৩, ৭:৪১ অপরাহ্ণ / Print This Post Print This Post
ব্যাংকে বেড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত

 

দেশে বাড়ছে ঈদকেন্দ্রিক রেমিট্যান্স ও রপ্তানি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রথম কিস্তির ঋণ বাবদ ডলারও দেশে এসেছে। ফলে ডলার সংকটে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভের বাইরে জানুয়ারির চেয়ে মার্চ মাসে দেশের সবগুলো ব্যাংকে ডলারের মজুত বেড়েছে। ব্যাংকগুলোও আগের তুলনায় ‘বেশি’ আমদানির চাহিদাপত্রের (এলসি) অনুমোদন দিচ্ছে। সব মিলিয়ে ঈদের হাওয়ায় স্বস্তি ফিরছে ডলারে। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।

একাধিক ব্যাংকের কর্মকর্তা জানান, এতদিন বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ থেকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে ডলারের জোগান দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে তেমন ডলার দরকার হয় না। প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয় দিয়ে আমদানির জন্য এলসি খুলতে ‘তেমন সমস্যা’ হচ্ছে না।

ডলার সংকট নিয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর জানান, রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়ার ধারা অব্যাহত থাকলে ডলার সংকট অনেকটাই কেটে যাবে। গত বছর রেকর্ড পরিমাণ কর্মী বাইরে গেছেন। তাই প্রবাসীদের আয় বাড়ার সম্ভাবনাই বেশি।

করোনা মহামারিতে বিশ্বজুড়ে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়। এরপর শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। আর তাতে খাদ্য ও জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থা আরো সংকটে পড়ে। ফলে বিশ্ববাজারে বেড়ে যায় এসব পণ্যের দাম।

বাংলাদেশসহ আমদানিনির্ভর দেশগুলো সবচেয়ে বেকায়দায় পড়ে। আমদানি ব্যয়ের তুলনায় রপ্তানিতে গতি না আসায় বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে হয় ৩৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি। আশানুরূপ রেমিট্যান্স না থাকায় চলতি হিসাবের ভারসাম্যেও দেখা দেয় বড় ধরনের ঘাটতি। বাজারে প্রকট হতে শুরু করে ডলারের সংকট। বারবার টাকার মান কমিয়েও যা সামাল দেয়া যায়নি।

অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। এ সময়ে আমদানি হয়েছে প্রায় ৩৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। অন্যদিকে রপ্তানি আয় হয়েছে প্রায় ২৬ বিলিয়ন ডলার। আর রেমিট্যান্স ১০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। যা বাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স বাড়াতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগামীতে দুটি বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা রয়েছে। এ কারণে আগামীতে রেমিট্যান্স বেশি পরিমাণে আসবে। ফলে ডলারের সংকট অনেকটাই কেটে যাবে।

জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী এবং সাবেক এবিবি চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও সেটি আগের অবস্থানে পৌঁছায়নি। এখনো ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করছে ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকও রাখছে কঠোর নজরদারিতে। তবে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়ায় ডলারের বাজারে কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে। এ অবস্থা আরো

যদিও বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ডলার সংকটের কারণে এখন সব শিল্পেই কাঁচামালের সংকট দেখা দিয়েছে। দেশীয় শিল্প এখন কাঁচামাল সংকটে উৎপাদন করতে পারছে না। তাদের ডলার আয় না থাকায় এলসি খুলতেও পারছেন না।

বেসরকারি খাতের ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের (ইবিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী আলী রেজা ইফতেখার বলেন, ডলার সংকটের চ্যালেঞ্জ এখনো রয়েছে। রমজান এবং ঈদকে ঘিরে এ মাসে রেমিট্যান্স কিছুটা বাড়ছে, তবে রপ্তানিতে আবার কিছুটা নিম্নগামী দেখা যাচ্ছে। সুতরাং খুব বড় ধরনের পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না। তবে তিন-চার মাস আগে যে ধরনের সংকট ছিল, সেখান থেকে কিছুটা স্বস্তি মিলেছে। এখনো সংকট পুরোপুরি নিরসন হয়নি।

তিনি বলেন, আমাদের দেশে দুই ঈদকে কেন্দ্র করে প্রবাসীরা তাদের আত্মীয় পরিজনদের কাছে অর্থ পাঠান। ফলে এ সময়ে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়ে। তবে তা ডলারে খুব সামান্যই স্বস্তি দিতে পারবে। কারণ ঈদের পরে রেমিট্যান্স যদি আবার কমে যায় তাহলে আগের পরিস্থিতিই সৃষ্টি হবে। তাই সরকারের উচিত রেমিট্যান্স আরো বাড়ানোর জন্য পদক্ষেপ নেয়া।

তিনি বলেন, ইস্টার্ন ব্যাংক বরাবরই বাফেদা ও এবিবির রেট অনুযায়ী ১০৭ টাকা ৫০ পয়সা করে ডলার বিক্রি করছে। ডলারের প্রবাহ বাড়াতে আমরা নানা ধরনের পদক্ষেপও নিয়েছি। রপ্তানিকারকদের সঙ্গে কথা বলছি। কম প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে নিরুৎসাহিত করছি। রেমিটারদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছি। বিভিন্ন এক্সচেঞ্জ হাউসের সঙ্গে চুক্তি করেছি।

সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, রেমিট্যান্স ও রপ্তানির আয় প্রবাহ সম্প্রতি বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি মাসের ১ থেকে ২৪ তারিখ পর্যন্ত দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১৫৯ কোটি ৭৫ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার। এ হিসাবে দৈনিক গড়ে এসেছে ছয় কোটি ৬৬ লাখ ডলার। এর আগের মাসে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারিতে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৫৬ কোটি ১২ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলার। রেমিট্যান্স প্রবাহের চলমান ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি মাসের শেষে রেমিট্যান্স দুই বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।
বছরের হিসাবেও এবার রেমিট্যান্স বেশি এসেছে।

অর্থাৎ, ২০২২ সালে জানুয়ারি মাসের চেয়ে চলতি বছর জানুয়ারিতে ১৫ শতাংশ বেশি রেমিট্যান্স এসেছে। এ বছর জানুয়ারিতে ১৯৬ কোটি ২৬ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৭০ কোটি ৪৫ লাখ ডলার। এ বছর ফেব্রুয়ারিতে প্রবাসীরা আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থায় পাঠিয়েছেন ১৫৬ কোটি ১২ লাখ ডলার। ২০২২ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৪৯ কোটি ৪৪ লাখ ডলার। সে হিসাবেও ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের চেয়ে এ বছর ফেব্রুয়ারিতে রেমিট্যান্স বেড়েছে ৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ।

এদিকে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) আট মাসে রপ্তানি আয় এসেছে ৩৭ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেশি। আগের বছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি আট মাসে রপ্তানি আয় এসেছিল ৩৩ দশমিক ৮৪৩ বিলিয়ন ডলার।

দেশের রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম প্রতিষ্ঠান হ্যাভেন কানিট গার্মেন্টস লিমিটেড। রপ্তানির পোশাক তৈরির জন্য কাঁচামাল আমদানি করতে হয় প্রতিষ্ঠানটিকে। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা জামাল পাশা বলেন, এখনো স্বাভাবিকভাবে ঋণপত্র বা এলসি খুলতে পারছি না। তবে কয়েক মাস আগের তুলনায় এখন একটু সময় বেশি লাগলেও এলসি খুলতে কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছি।

তিনি জানান, তার প্রতিষ্ঠানের মেশিনের যন্ত্রপাতি ও কিছু ফেব্রিক্স বা কাপড় দেশের বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়। এ রকমই রপ্তানিকারক একটি প্রতিষ্ঠান অনন্যা নিটেক্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আছাদুজ্জামান চুন্নু বলেন, প্রয়োজন অনুযায়ী কাঁচামাল আমদানি করতে পারছি।

সংকট নিরসনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপ : ডলার সংকট নিরসনে সম্প্রতি একটি সার্কুলারে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী পণ্য রপ্তানি করার চার মাসের মধ্যে রপ্তানি আয় দেশে আনার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আর ওই সময়ের মধ্যেই তা নগদায়ন করার নিয়ম। কিন্তু অনেক রপ্তানিকারক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ডলার দেশে আনতে পারেন না। বর্তমান নিয়মে তিনি যে সময়ে ডলার দেশে আনেন সেই সময়ের দামই পান। নতুন নিয়মে তা পাওয়া যাবে না। রপ্তানি আয় দেশে আনার সর্বশেষ সময়ে ডলারের যে দাম ছিল সেই দাম পাবেন। একই সঙ্গে রপ্তানি আয় দেশে আনার নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ডলার নগদায়ন না করে পরে করলেও যে সময়ের মধ্যে রপ্তানি আয় দেশে আসার কথা ছিল, ওই সময়ের শেষ দিনের ডলারের দাম অনুযায়ী তার আয় নগদায়ন হবে। অর্থাৎ ডলারের দাম হ্রাস-বৃদ্ধি যাই হোক, গ্রাহক নির্দিষ্ট ওই দিনের বিনিময় হার অনুযায়ী তার রপ্তানি আয়ের বিপরীতে টাকা পাবেন।

সার্কুলারে আরো বলা হয়েছে, প্রতিটি ব্যাংককে রপ্তানি আয় দেশে আসার সর্বশেষ তারিখ ও নগদায়নের তারিখে থাকা ডলারের দাম অনলাইনে লিপিবদ্ধ রাখতে হবে। প্রতি মাস শেষে পরবর্তী ১০ দিনের মধ্যে তা বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে হবে। এসব তথ্য পাঠানোর বিষয়ে একটি নির্ধারিত ছকও দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে রপ্তানির তারিখ, কত দিনের মধ্যে আয় দেশে আসার কথা, কবে এলো এসব তথ্য দিতে হবে। বর্তমানে রপ্তানি আয়ের বিপরীতে প্রতি ডলারে ১০৪ টাকা করে দেয়া হয়। ১ মার্চ থেকে এই দর কার্যকর হয়েছে। এর আগে ছিল ১০৩ টাকা।

প্রসঙ্গত, ডলার সংকটে আমদানির চাহিদা মেটাতে চলতি অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়। ফলে গত সোমবার রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার।


আর্কাইভ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০৩১