বিষয় ও অভিনয় কৌশল  : বাংলার লৌকিক খেলা


সাহিত্য লেখা প্রকাশের সময় : জানুয়ারি ২৪, ২০২৩, ১১:০৬ অপরাহ্ণ / Print This Post Print This Post
বিষয় ও অভিনয় কৌশল  : বাংলার লৌকিক খেলা

অধ্যাপক ড. মো. সানোয়ার হোসেন

সভ্যতার সূচনাকাল থেকে মানুষ জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে সৃষ্টি করেছে বিনোদনের নানা মাধ্যম। কারণ মানুষ প্রাত্যাহিক জীবনের নানাবিধ কাজের অবসরে খানিকটা হলেও বিনোদনের প্রয়োজন অনুভব করে। বিনোদন ছাড়া মানুষের চিত্তের বিকাশ ঘটে না, দৈনন্দিন কাজেও আসে ক্লান্তি। সঙ্গত কারণেই বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে শিল্প সাহিত্য, খেলাধুলা, নাচ-গান, চিত্রকলা, জাদুমন্ত্র, চলচ্চিত্রসহ কালের ধারাবহিকতায় আরও কত কী যে সৃষ্টি হয়েছে, তার অন্ত নেই। বিনোদনের সেসব নানা মাধ্যমের মধ্যে শিল্প-সাহিত্য একটি দেশ বা জাতির প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। একই সঙ্গে বলা যায়, খেলাধুলা একটি দেশ বা জাতির বীরত্বগাথা, উৎসাহ-উদ্দীপনা, শৌর্য ও সাহসিকতার পরিচয় অত্যন্ত দ্রুত বিশ্ববাসীর কাছে উদ্ভাসিত হয়। খেলাধুলা মানুষের শরীর-মনকে সুস্থ ও সুন্দর রাখতে সহায়তা করে। অনেকের মতে, কেবল আনন্দমুখর জাতিই পারে অসাধ্য সাধন করতে। এ কারণে আধুনিক বিশ্বের বহু দেশ আছে, যারা খেলাধুলার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করে থাকে।

প্রাচীনকাল থেকেই নানা দেশে শ্রমজীবী মানুষে জীবন-জীবিকার ব্যস্ততার মাঝে অবসর সময়কে কিছুটা আনন্দময় করে তোলার প্রয়োজনের তাগিদ থেকে উদ্ভব হয়েছে বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা। সুদীর্ঘকাল থেকে বিশ্বব্যাপী উদ্ভাবিত ও প্রচলিত সেসব খেলাধুলার দু’টি ধারা বিদ্যমান।

প্রথমত, নগরকেন্দ্রিক খেলাধুলা। যেমন- ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিস, লন টেনিস ইত্যাদি। দ্বিতীয়ত, গ্রামীণ সমাজ থেকে উৎসারিত লৌকিক খেলাধুলা। যেমন- আদা খেলা, কানামাছি খেলা, পালকি খেলা, লাঠিখেলাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জে অজস্র খেলাধুলার প্রচলন ছিল এবং আজও আছে। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে গ্রামবাংলায় প্রচলিত লৌকিক খেলাধুলা বিলুপ্ত প্রায়। বিশ্বব্যাপী খেলাধুলার মধ্যে কিছু কিছু খেলা আছে, যা স্ব-স্ব জাতির ঐতিহ্যকে ধারণ করে বা বহন করে। আবার কিছু কিছু খেলা আছে, যা সার্বজনীন। যেমন- ফুটবল, ক্রিকেট, টেনিস ইত্যাদি। এ ধরনের খেলাধুলা সব দেশ বা জাতির মধ্যে অভিন্ন ধারায় প্রচলিত। হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির বিষয়-বৈচিত্র্যের মধ্যে যেমন সুদীর্ঘকাল ধরে বহুতর বিষয় ও আঙ্গিকনির্ভর দর্শক-শ্রোতার উপস্থিতিতে উপস্থাপনযোগ্য আখ্যান-কাব্যের পরিচয় পাওয়া যায়, তেমনি আবহমানকাল ধরে বাঙালির সমাজ-সংস্কৃতির বিকাশের ধারাবাহিকতায় এ দেশে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য ঐতিহ্যবাহী বা লৌকিক খেলাধুলা। বর্তমানে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের নানা ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া সংস্কৃতির প্রভাবে এবং বাংলার গ্রামাঞ্চল ক্রমাগত নগরায়ণের ফলে এদেশের লৌকিক খেলাধুলা বিলুপ্ত হতে চলেছে। অথচ বাঙালি জাতির বীরত্বগাথার পরিচয় বহন করে এবং বাঙালির ঐতিহ্যকে ধারণ করে এমন বহু খেলা নানা স্থানে নানা নামে প্রাচীনকাল থেকে বাংলা ভাষাভাষি অঞ্চলে প্রচলিত হয়ে আসছে। যা শুধু খেলা নয়, একই সঙ্গে তা বাংলা লোকনাট্যের বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। বাংলার লৌকিক খেলাধুলার মধ্যে এমন কয়েকটি খেলার নাম চামড়ি খেলা, ছাগলধরা খেলা, বুড়া-বুড়ির খেলা। এসব খেলার বিষয় ও পরিবেশনে লোকনাট্যের বৈশিষ্ট্য কী রূপে বিদ্যমান, তা আলোচনা করাই এ প্রবন্ধের মূল উদ্দেশ্য।

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাংলা লৌকিক খেলাধুলার পরিচয় পাওয়া যায় ড. ওয়াকিল আহমদ রচিত ‘বাংলার লোক সংস্কৃতি’, ড. মাজহারুল ইসলামের ‘ফোকলোর ও লোক সাহিত্যের পঠন পাঠন’, সিরাজুল ইসলাম সম্পাদিত ‘বাংলাপিডিয়া’, সেলিম আল দীনের ‘বাংলা নাট্যকোষ’, শাকির উদ্দীন সম্পাদিত ‘ময়মনসিংহের সাহিত্য ও সংস্কৃতি’, শঙ্কর সেন গুপ্ত রচিত ‘বাঙালির খেলাধুলা’, হাবিবুল্লা পাঠান রচিত ‘নরসিংদীর লৌকিক খেলাধুলা’, সামিয়ুল ইসলাম রচিত ‘বাংলাদেশের গ্রামীণ খেলাধুলা’ ইত্যাদি গ্রন্থে। সামিয়ুল ইসলাম রচিত ‘বাংলাদেশের গ্রামীণ খেলাধুলা’ গ্রন্থে নাট্যধর্মী খেলা হিসেবে কইল্যা খেলা, কৈতর-বাচা খেলা, চামড়ি খেলা, ছাগলধরা খেলা, টিয়ারে টিয়া খেলা, দুধা বা বাঘ বাঘ খেলা, ধান নেড়ে দেওয়া খেলা, বুড়া-বুড়ির খেলা, রাজার কোটাল খেলা ইত্যাদির উল্লেখ আছে। নাটকীয় উপাদান সমৃদ্ধ এসব খেলাধুলার মধ্যে টিয়ারে টিয়া এবং বুড়া-বুড়ির খেলা মাজহারুল ইসলাম তরু রচিত ‘চাপাইনবাবগঞ্জের লোকসংস্কৃতি পরিচিতি’ গ্রন্থেও বর্ণিত হয়েছে। প্রসঙ্গত, উভয় গ্রন্থে লাঠিখেলার বিবরণ থাকলেও তা নাট্যধর্মী খেলা হিসেবে আলোকপাত করা হয়নি। অথচ বাংলাদেশে বহুল প্রচলিত ও জনপ্রিয় লোকক্রীড়ার মধ্যে লাঠিখেলাকে ‘কসরতমূলক নাট্য’ হিসেবে অভিহিত করা হয় (সেলিম আল দীন, বাংলা নাট্যকোষ, ২৯৯)। বাংলা লোকনাট্যের উপাদান সমৃদ্ধ লাঠিখেলার ন্যায় বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে যুগ যুগ ধরে অজস্র খেলাধুলার প্রচলন ছিল, হয়তো এখনো তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। যেমন- চামড়ি খেলা।

চামড়ি খেলা

চামড়ি খেলায় সাধারণত ১৫-২০ জন খেলোয়াড় অংশগ্রহণ করেন। তবে এর চেয়ে দুই একজন খেলোয়াড় কম-বেশি হলেও খেলতে খুব একটা অসুবিধা হয় না। নির্ধারিত খেলোয়াড়দের মধ্যে একজন দলপতি বা সর্দার থাকেন। তিনি প্রথমেই মাটিতে চৌকোনাকৃতির পুকুরের ন্যায় একটি রেখা অঙ্কন করেন। অন্য খেলোয়াড়গণ দুই দলে বিভক্ত হয়ে পুকুরের ন্যায় অঙ্কিত রেখার চারপাশে হাতে লাঠিসহ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ান। এরপর একদল অঙ্কিত রেখা মুছে ফেলার জন্য সামনের দিকে এগিয়ে যায় এবং অন্যদল তাতে বাঁধা প্রদান করে। ফলে উভয়পক্ষই প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে এবং হাতের লাঠি দিয়ে তারা একে অপরের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত হন। এই দ্বন্দ্ব-সংঘাত বিভিন্ন ধরনের অঙ্গভঙ্গি এবং বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে বেশ কিছুক্ষণ ধরে চলতে থাকে। একপর্যায়ে উভয়পক্ষই আকাশের দিকে লাঠি উঁচু করে ধরে।  হাতের লাঠি আকাশের দিকে উচুঁ করে তুলে ধরা মীমাংসার প্রতীকরূপে গণ্য হয়। এভাবে খেলাটির প্রথম পর্ব বা দৃশ্য সমাপ্ত হয়।

যুদ্ধে যে মানবমনে শান্তি আসে না, তা উভয়পক্ষই উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। এরূপ প্রেক্ষিতে উভয়পক্ষের খেলোয়াড়দের মধ্যে শান্তির বার্তা বাহিত হয়। এ শান্তির বার্তা নিয়ে শুরু হয় দ্বিতীয় দৃশ্য। এ দৃশ্যে উভয়পক্ষই বিজয়ের আনন্দে মেতে ওঠে। আনন্দপূর্ণ দৃশ্যটিকে আরও প্রাণবন্ত করার জন্য এবং আনন্দের মধ্য দিয়ে শান্তির বার্তা দর্শকের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য একপক্ষের একজন খেলায়াড় ওই স্থানে পানি ঢেলে দেয় এবং সেখানে তারা গড়াগড়ি করে সারা শরীর কাদা দিয়ে নোংরা করতে থাকে। একসময় একজন খেলোয়াড় কাঁদতে কাঁদতে চীৎকার করে বলে ওঠেন, ‘আমার হাতে শিং মাছের কাঁটা বিঁধেছে। তখন একজন খেলোয়াড় দৌঁড়ে গিয়ে ডাক্তার ডেকে নিয়ে আসেন। ডাক্তার এসে তাকে সেবা করেন। কিন্তু কিছুতেই তিনি ভালো হন না। বরং তার ব্যথা ক্রমশ তীব্রতর হয়। প্রচণ্ড ব্যথায় চিৎকার করে তিনি তার মাকে ডাকেন। মমতাময়ী মা এসে তাকে সেবা করেন কিন্তু তাতেও তিনি সুস্থ হন না। এরপর আরও জোরে চিৎকার করে তিনি তার বোনকে ডাকেন। কিন্তু স্নেহময়ী বোনের সেবায়ও তার ব্যথা দূর হয় না। উপায়ন্তর না দেখে এবার তিনি প্রচণ্ড জোরে দুই হাত মাটিতে আঘাতপূর্বক মরা কান্নার সুরে বলতে থাকেন:

আউগাও সোনাদোরী আউগাও
শিংগির বিশে মরয়ো গেনু মুই।

এরপর মরাকান্নার আওয়াজ শুনে একজন তন্বি-তরুণী তার রূপ-লাবণ্যের সৌরভ নিয়ে অসুস্থ খেলোয়াড়ের সামনে উপস্থিত হন। এরপর মৃদু হাসি দিয়ে রোমান্টিক দৃষ্টিতে রোগীর দিকে তাকান। ফলে একে অপরের মধ্যে চোখে চোখে যে কথার ও ভাবের আদান-প্রদান হয়, তাতে অসুস্থ খেলোয়াড় সঙ্গে সঙ্গে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেন। এরূপ কলা-কৌশলের মধ্য দিয়ে চামড়ি খেলা সমাপ্ত হয়। কোনো কোনো অঞ্চলে চামড়ি খেলা লাঠিখেলা নামেও পরিচিত (সামিয়ুল ইসলাম, বাংলাদেশের গ্রামীণ খেলাধুলা, ১৫৭ ও ১৫৮)।

চামড়ি খেলা বাংলার লৌকিক খেলা হিসেবে পরিচিত হলেও এ খেলা মূলত বাংলা লোকনাট্যের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। কারণ এ খেলার উপস্থাপন কৌশলে আছে একটি নাট্যকাহিনি এবং এর কাহিনিতে আছে চরিত্রের সংলাপ ও নাটক উপস্থাপনার দৃশ্য বিভাজনরীতি। যেমন- পুকুরের ছক কাটা, পুকুরকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের বীরত্বপূর্ণ লাঠির কসরৎ প্রদর্শন, মাছ ধরা, শিং মাছের কাঁটা বিদ্ধ একজন খেলোয়াড়ের মরাকান্না, চিকিৎসা এবং রোমান্টিক প্রেমের দৃশ্য। এসব দৃশ্য উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাগণ নাটকীয় শিল্পরসে সিক্ত হন। নাটকীয় গুণসম্পন্ন এ খেলা উপস্থাপনের জন্য আধুনিক কালের নাটক উপস্থাপনের ন্যায় মঞ্চ নির্মাণের প্রয়োজন হয় না। যে কোনো উন্মুক্ত স্থানে এ খেলা উপস্থাপন করা যায়। এতে মঞ্চ পরিকল্পনার ইঙ্গিত আছে। যেমন- মাছ ধরার দৃশ্যে পুকুর খনন করা। আবার এতে নাটকীয় চরিত্রের উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করা যায়। যেমন- সর্দার, রোগী, ডাক্তার, রোগীর মা ও বোন এবং একজন ষোড়শী। উল্লেখিত চরিত্র ব্যাতিরেকে বাংলা লোকনাট্যের ন্যায় একাধিক খেলোয়াড় বা অভিনেতা অংশগ্রহণ করেন। বাদ্যযন্ত্রীদলের বাদ্য বাজানো এবং প্রপস হিসেবে লাঠির ব্যবহারও আছে এতে। সুতরাং খেলাটিকে শুধু খেলা হিসেবে অভিহিত না করে পরিবেশনমূলক নাট্য হিসেবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। বাংলাদেশে এরূপ অসংখ্য লৌকিক খেলাধুলার মধ্যে ছাগল ধরা খেলা এবং বুড়া-বুড়ির খেলার কথাও বলা যেতে পারে।

ছাগলধরা খেলা

এ খেলার শুরুতেই যথাসম্ভব যে কোনো উন্মুক্ত স্থানে বড় একটি বৃত্ত রচনা করা হয়। ওই বৃত্তের ভেতর একজন খেলোয়াড় বা একজন অভিনেতা ছাগলের চরিত্রে অভিনয় করার জন্য প্রবেশ করেন। বৃত্তটিকে একটি ফসলি জমি হিসেবে কল্পনা করা হয়। এ জমি বা বৃত্তটিকে ঘিরেই থাকে ছাগলের মালিক এবং জমির মালিক। ছাগলটি যখন ফসল খাওয়ার ভঙ্গি প্রদর্শন করে তখন জমির মালিক ছাগলের মালিককে উদ্দেশ্য করে বলেন:

আতু আতু লে লে
ছাগিয়ে মরিচ খায়রে।
কোন হালার ছাগি রে
ধরি এনে বান রে।
কপাল পুড়া ধপাল পুড়া
অলক্ষীর চিন
ঘোড়া মারা ডাকাই দেনি
হাওয়াই পূজার দিন।

এ কথা শুনে ছাগলের মালিক কোনো কর্ণপাত করেন না। ফলে জমির মালিক ক্ষিপ্ত হয়ে চিৎকার করে ছাগলের মালিককে উদ্দেশ্য করে বলেন:

জমির মালিক: ছইইল্যারে (ছাগলের মালিক) ভাই?
ছাগলের মালিক: কিয়ল্লাই (কি জন্যে)
জমির মালিক: তোর ছঅলে কি খায়?
ছাগলের মালিক: হারবার ডানডি।
জমির মালিক: আর কি খায়?
ছাগলের মলিক: কানাইয়ার আগা।
জমির মালিক: মুতে কেমন?
ছাগলের মালিক: বাড়ি বাড়ি।
জমির মালিক: লাদে কেমন?
ছাগলের মালিক: হইলদের গুডি।

ছাগলের মালিক এ কথা শুনে জমির মালিককে চিৎকার করে বলতে থাকেন:

ছাগল খুর খুড়ি বান্দে কোঁ রে?
তোর ছাগলে ধান খায়
একটি ছাগল বান্দা খায়।

এরপর সে ছাগলটিকে দ্রুত ধরতে যায়। তার সঙ্গে সঙ্গে বৃত্ত রচনায় অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড় বা অভিনেতারাও ছাগলটিকে ধরার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে। কিন্তু ছাগল সবাইকে ফাঁকি দিয়ে বৃত্তের বাইরে চলে যায়। এবার সবাই মিলে  দৌঁড়াতে থাকে ছাগলটিকে ধরার জন্য। যিনি ছাগলটিকে ধরতে পারবেন, পুনরায় খেলা আরম্ভ হলে তিনিই হবেন ছাগলরূপী খেলোয়াড় বা অভিনেতা (সূত্র: বাংলাদেশের গ্রামীণ খেলাধুলা)।

এ খেলার মধ্য দিয়ে শুধু আনন্দ-বিনোদন নয়, একই সঙ্গে এ খেলা পরিবেশনের মধ্য দিয়ে গ্রামীণ সমাজে বসবাসরত কৃষিজীবী মানুষের চলমান জীবনের ক্ষীণরূপ প্রকাশ পেয়েছে। সাধারণত এ খেলা ভূমি সমতল বৃত্ত মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয়। খেলাটির পরিবেশনে প্রত্যক্ষ করা যায় অভিনয় ও রূপসজ্জার। এ ছাড়া কাহিনি, চরিত্র এবং হাস্যরসপূর্ণ সংলাপের মাধ্যমে পরিবেশিত এ খেলায় উপস্থিত দর্শক-শ্রোতা খেলার বিনোদন গ্রহণ করার পাশাপাশি নাটকীয় শিল্পরস উপভোগ করেন। কাজেই এ খেলা শুধু খেলা নয়, একই সঙ্গে নাট্যাভিনয়ও বটে। সুতরাং এর বিষয় ও পরিবেশনরীতি বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ‘ছাগলধরা খেলা’ মূলত লোকনাট্যের বৈশিষ্ট্যজাত।

বুড়া-বুড়ির খেলা

খেলাটি সাধারণত বালক বা বালিকারা খেলে থাকে। মাত্র দুইজন খেলোয়াড় এতে অংশগ্রহণ করে থাকে। খেলোয়াড়দের মধ্যে একজন বালক বা বালিকা চুনের সাহায্যে চুল, দাড়ি ও গোঁফ পাকিয়ে বুড়া সাজে। তার হাতে একটি পাচন থাকে।

অন্য খেলোয়াড় একটি শাড়ি এবং পাটের আঁশ দ্বারা তৈরি আলগা চুল মাথায় পরিধান করে বুড়ি সাজে। এই বুড়ি শত বৎসরের বৃদ্ধার মতো মধ্যমা আঙুলের ডগায় চুন রেখে পান খায় এবং একটি লাঠিতে ভর দিয়ে কোমর বাঁকিয়ে পানের পিক ফেলতে ফেলতে সামনের দিকে অগ্রসর হয়। এদিকে বুড়া কাঁধে লাঙল-জোয়াল নিয়ে বুড়ির সামনে উপস্থিত হয়। তারপর শুরু হয় বুড়া-বুড়ির সংলাপ:

বুড়া: ভাত রাইন্ধা দিবা তুমি
হাল বাইতে যাব আমি।

বুড়ি: ভাত রান্ধতে পারমু না
বাপের বাড়ি যাইমু গা।।

বুড়া: বাপের বাড়ি যাইবা তুমি
চুল ধইরা আনমু আমি।।

বুড়ি: চুল ধইরা আনবা তুমি
খাম ধইরা থাকমু আমি।।

বুড়া: খাম ধইরা থাকবা তুমি
কান ধইরা আনমু আমি।।

বুড়ি: কান ধইরা টানবা তুমি
থু থু দিয়া পলাইমু আমি।।

বুড়া: থু থু দিয়া পলাইবা তুমি
চুল ধইরা টানমু আমি।।

বুড়ি: চুল ধইরা টানবা তুমি
আগুনে পুইড়া মরবো আমি।।

বুড়ি: আগুনে পুইরা মরবা তুমি
তোমার সাথে মরমু আমি।।

(সামিয়ুল ইসলাম, বাংলাদেশের গ্রামীণ খেলাধুলা, ১৬৬)

এ খেলায় নাট্যিক উপাদান বিদ্যমান আছে বলেই সামিয়ুল ইসলাম তাঁর ‘বাংলাদেশের গ্রামীণ খেলাধুলা’ গ্রন্থে খেলাটিকে নাট্যধর্মী বলেছেন। তার এ অভিমত নিঃসন্দেহে যৌক্তিক। কারণ নাটকের বিষয় হিসেবে এ খেলায় প্রত্যক্ষ করা যায় বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে বসবাসরত কৃষাণ-কৃষাণীর মিলন বিরহের বাস্তব চিত্র। এতে প্রপস হিসেবে বুড়া-বুড়ির পাচন ও লাঠির ব্যবহার, সংলাপ, চরিত্রের রূপসজ্জা-এসবই নাট্যাভিনয়ের বৈশিষ্ট্যজাত। চুন দিয়ে চুল-দাড়ি পাকানো ও পাটের আঁশ দিয়ে তৈরি আলগা চুল মাথায় পরে অভিনয় করার রীতি বাংলা লোকনাট্য এবং কখনো কখনো প্রচলিত মঞ্চ নাটকের অভিনয়েও প্রত্যক্ষ করা যায়।

সুতরাং বুড়া-বুড়ির খেলাকে শুধু খেলা না বলে বুড়া-বুড়ির নাট্যও বলা যেতে পারে। এভাবে বাংলাদেশের শ্রমজীবী বিশেষ করে কৃষিজীবী মানুষের বিচিত্র ভাবনা বা প্রয়োজনের অনুষঙ্গ হিসেবে সৃষ্টি হয়েছে নাটকের বৈশিষ্ট্যজাত অসংখ্য লৌকিক খেলাধুলা, যা একই সঙ্গে লোকনাট্য হিসেবেও সমাদৃত হতে পারে। গ্রামীণ সমাজে শত শহস্র বৎসর ধরে প্রচলিত এ ধরনের খেলাধুলা নাট্যরুচির নিরীখে গবেষণা হলে বাংলা নাট্য সাহিত্যের ইতিহাস আরও সমৃদ্ধ হতে পারে।

SK24/SMK/DESK


আর্কাইভ